বদলে যাচ্ছে বৃষ্টিপাতের ধরন
জুলাই মাসে দেশে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ কম। অথচ দেশের আবহাওয়াপঞ্জিতে এই মাসটি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের সময়। আবার চলতি মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হতে পারে বলেও পূর্বাভাস তাদের। এই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে।আবহাওয়া বিভাগের হিসাব বলছে, এই আগস্টেও দেশের সর্বত্র স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। এ মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ৫৫৬ মিলিমিটার; অথচ মাসের ১০ দিন বাকি থাকতেই এই বিভাগের একাংশ—কক্সবাজার-টেকনাফে বৃষ্টিপাত ৫০০ মিলিমিটার ছাড়িয়েছে। আবার একই বিভাগের মিরসরাইয়ে তেমন বৃষ্টি নেই। সিলেট বিভাগে আগস্ট মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৪৫৬ মিলিমিটার। অথচ সুনামগঞ্জে ইতিমধ্যে বৃষ্টিপাত হাজার মিলিমিটার ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে স্বাভাবিকের তুলনায় কম। বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে বৃষ্টিপাতের এই চিত্র স্বাভাবিক নয়। তবে কয়েক বছর ধরে এমনটাই হচ্ছে।
এখন শুধু যে একেক সময় একেক অঞ্চলে বৃষ্টি হয়, তা নয়। জুলাইয়ে যে রকম বৃষ্টি হওয়ার কথা, তা হয়তো হচ্ছে সেপ্টেম্বরে। হয়তো জুনের শুরুতেই প্রবল বৃষ্টি হলো। তারপর একটানা সাত দিন কিংবা ১০ দিন একেবারে বৃষ্টিহীন, খড়খড়ে।
বৃষ্টিপাতের ধরনে এই যে পরিবর্তন, তা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করছেন দেশের কৃষক। জীবনভর যে কৃষক বৃষ্টির পানিতে জমি চাষ করে আমন ধান ফলিয়েছেন, পাট পচিয়েছেন, এখন বর্ষাকালে তাঁদের কারও কারও ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে যায়। পাট পচানোর মতো পানিভরা পুকুর-ডোবা এখন আর সব এলাকায় পাওয়া যায় না। আগে যেভাবে মৌসুম হিসাব করে চাষাবাদ করতেন, এখন অনেক কৃষকেরই সে হিসাব আর মেলে না।
ঢাকায় স্থায়ী এক ব্যবসায়ীর জমি চাষ করেন সুবর্ণচরের বর্গাচাষি ইমান আলী। গত মঙ্গলবার ওই ব্যবসায়ীকে ইমান আলী ফোন করে বলেন, সপ্তাহ খানেক ধরে চলা বৃষ্টিতে খুব উপকার হচ্ছে। এই বৃষ্টিটা না হলে এবার অনেক জমিই অনাবাদি থাকত। ঢাকার ওই ব্যবসায়ী বলেন, জুলাইয়ে বৃষ্টি খুব কম হয়েছে তাঁদের এলাকায়। তাই এবার তাঁদের আমন চাষ বিলম্বিত হচ্ছে।
ধীরে ধীরে কৃষকের এই অসুবিধা এতই প্রকট হয়ে উঠছে যে আমন মৌসুমে সেচ দেওয়াও শুরু হয়েছে। অনেক এলাকায় কৃষক নিজে থেকেই এ রকম সেচের ব্যবস্থা করেছেন। কোনো কোনো এলাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও কৃষকদের একই পরামর্শ দিচ্ছেন।
বৃষ্টিপাতের ধরন যে বদলে যাচ্ছে, সেই পর্যবেক্ষণ দেশের দুটি প্রধান প্রতিষ্ঠান—মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডেরও। একই কথা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞরা। তবে আবহাওয়াবিদেরা একেবারে স্পষ্ট করে এ কথা এখনো বলতে চান না।
স্পারসোর আবহাওয়া বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বৃষ্টিপাতের ধরন বদলাচ্ছে। হয়তো একটানা অনেক বছর একইভাবে এই পরিবর্তন চোখে পড়ে না। কিন্তু পরিবর্তন একটা স্পষ্টই হচ্ছে। স্পারসোর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের ভিত্তি হলো কয়েকটি বিদেশি কৃত্রিম উপগ্রহের তথ্য। সেই তথ্য তাঁরা আবহাওয়া অধিদপ্তরকেও দেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দেশের শতাধিক স্থানে পানির স্তরের পাশাপাশি বৃষ্টিপাতের পরিমাণও পরিমাপ করে। পাউবোর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এটা স্পষ্ট যে বৃষ্টিপাতের ধরন আর আগের মতো নেই। যখন যতটা হওয়ার কথা তখন ততটা হয় না। অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়। বাকি সময় থাকে বৃষ্টিহীন।
আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থার (আইইউসিএন) সাবেক দেশীয় প্রধান এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের পক্ষে অন্যতম মধ্যস্থতাকারী অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, বৃষ্টিপাতের ধরন বদলাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এটা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে অনেকে সেটা বলতে দ্বিধা করছেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এটা আরও বদলাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পর্যবেক্ষণকারী এই পানিবিশেষজ্ঞ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য ২০০৯ সালে সরকার যে মহাপরিকল্পনা অনুমোদন করেছে, সেখানেও এই বিষয়টি উল্লেখ আছে। ২০১৩ সালের আইপিসিসি-৫-এর দলিলে এটা আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়; পৃথিবীর প্রতিটি দেশ এখন বলছে, বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাওয়াটা এখন বাস্তব।
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ছাদেকুল ইসলামের অভিমত কিছুটা ভিন্ন। তিনি বলেন, কোনো কোনো বছর বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিকতায় কিছুটা ব্যত্যয় ঘটে। এমনকি, একটানা দু-তিন বছরও এটা হতে দেখা যায়। আবহাওয়ার দীর্ঘ ৫০-৬০ বছরের যে তথ্য অধিদপ্তরে সংরক্ষিত, সেখানে এমন ঘটনা অনেকবার ঘটার তথ্য পাওয়া যায়। তাই এটাই বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাওয়ার নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা যায় না।
অবশ্য ছাদেকুল ইসলাম এ কথাও বলেন, সারা দেশের প্রতিটি স্থানের, এমনকি অধিকাংশ স্থানের বৃষ্টিপাতের তথ্য আবহাওয়া অধিদপ্তরে নেই। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার (আইএমও) হিসাব অনুযায়ী, কোনো দেশ বা অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে হলে প্রতি ১৫ কিলোমিটার অন্তর একটি করে পরিমাপক যন্ত্র (রেইন গেজ) থাকতে হবে। সে হিসাবে দেশে এই যন্ত্র বসানো দরকার এক হাজার ৫০০টি; কিন্তু নেই একটিও। এখানে বৃষ্টিপাত পরিমাপ করা হয় ৩৫টি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের মাধ্যমে, আবহাওয়ার অন্যান্য উপাদানের (তাপমাত্রা, বাতাসের গতিপ্রকৃতি, চাপ প্রভৃতি) সঙ্গে।