বন্যা পরিস্থিতি অবনতি, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে ৫ লাখ বানভাসি মানুষের
ত্রাণ এবং পূর্নবাসন ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগের মুখে দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে প্রায় ৫ লাখ বানভাসি মানুষের। অনেক পরিবার ঘর ছেড়ে উঁচু মাচা ও কলাগাছের ভেলায় অবস্থান করছে। এখন পর্যন্ত অনেক স্থানে কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি।
দেশের প্রধান নদীগুলোর পানি গতকাল শনিবারও কমেনি। পানিবন্দি কয়েক লাখ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বাড়িঘরের সাথে তলিয়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকার রোপা আমন, আউশ ও সবজি ক্ষেত। বন্ধ হয়ে গেছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু উত্তরাঞ্চলেই পাঁচ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে। কয়েকটি জেলায় নদ-নদীর পানি কমতে থাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস তথ্যকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৮৩টি পয়েন্টের মধ্যে ৫১টি স্টেশনে পানি বেড়েছে। এরমধ্যে বিপদসীমার ওপর দিয়ে ১৬ নদীর পানি প্রবাহিত হয়। কমেছে ২৬টি পয়েন্টে। অপরিবর্তিত রয়েছে ৭টিতে।
বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি হিসাবেই গতকাল পর্যন্ত ১৯ জেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। বানভাসি মানুষের জন্য গতকাল পর্যন্ত দেড় হাজার টন চাল ও ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ সাহায্য অপ্রতুল বলে অভিযোগ করছেন বানভাসি মানুষ।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, সিরাজগঞ্জ থেকে সারিয়াকান্দি পর্যন্ত জেলাগুলোয় যমুনার পানি অন্তত এক সপ্তাহ বিপদসীমার ওপরে থাকবে। সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়া ও আশপাশের জেলাগুলোতে প্রতিদিন গড়ে চার মিটার পানি কমে আসতে থাকলেও উজানের এই পানি প্রধানত ঢাকার চারপাশের ভাটি অঞ্চল বা মধ্যাঞ্চলের নদীগুলোর পানি বাড়িয়ে তুলছে এবং বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ স্থানগুলোর মধ্যে মানিকগঞ্জ, আরিচা, টাঙ্গাইল, মুন্সীগঞ্জ, মাওয়া, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলে পদ্মা ও এর সঙ্গে যুক্ত নদী-শাখা নদী রয়েছে।
উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন স্থানে সুরমা ও এর আশপাশের নদীর পানি বাড়ছে। এ প্রবণতা তিন-চার দিন থাকতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল শনিবার জানিয়েছে, পদ্মা নদীর পানি গোলালন্দ, সুরেশ্বর ও ভাগ্যকূলে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ, আরিচা, তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে, ঘাগট নদীর পানি গাইবান্ধায়, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারীতে, সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ ও দিরাইয়ে, কংস নদের পানি জারিয়া-ঝাঞ্জাইলে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের (এনডিআরসিসি) হিসেবে এরই মধ্যে ১৯ জেলার ৯৬ হাজার ১৯৭ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পরিবারপ্রতি সদস্যসংখ্যা গড়ে ৫ জন ধরা হলে ২২ আগস্ট পর্যন্ত দুর্গত মানুষের সংখ্যা চার লাখ ৮০ হাজার ৯৮৫।
শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জামালপুরের ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার জন্য ২৪ টন জিআর চাল ও ৫ লাখ টাকা উপ-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার দোহার উপজেলার জন্য ৪০ টন চাল এবং নগদ অর্থসহায়তা হিসেবে চার লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া নেত্রকোনার জন্য দুই টন চাল ও ৩৫ হাজার টাকা, লালমনিরহাটের জন্য ৮১ টন চাল ও এক লাখ টাকা, নীলফামারীর জন্য ২০ টন চাল ও ৪৫ হাজার টাকা, গাইবান্ধার জন্য ২০০ টন চাল ও তিন লাখ টাকা, কুড়িগ্রামের জন্য ১৬০ টন চাল ও এক লাখ ৪৩ হাজার টাকা, সুনামগঞ্জের জন্য ১০ টন চাল, নোয়াখালীর জন্য ৩০ টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা, রংপুরের জন্য ১০ টন চাল ও ৩০ হাজার টাকা, সিরাজগঞ্জের জন্য ৮০ টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা, বগুড়া জেলার জন্য ১৩৫ টন চাল ও এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। এসব ত্রাণ সহায়তাকে নগণ্য বলে অভিহিত করেছেন বানভাসীরা।
গত কয়েকদিনের বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ এখনও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ করা হলেও তা অপ্রতুল। এ ছাড়া বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় ৫০০ একর জমির রোপা আমন তলিয়ে গেছে। কুড়িগ্রামে নদ-নদীগুলোতে পানি কমতে থাকলেও বৃষ্টি হওয়ায় ২১৮টি গ্রামের পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মায় পানি বেড়ে যাওয়ায় ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে। বগুড়ায় যমুনার পানি কমতে থাকলেও সারিয়াকান্দিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬০ মিটার ধসে গেছে। সিরাজগঞ্জের ৫০ গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া মাগুরার মহম্মদপুর, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ, মানিকগঞ্জের শিবালয় এবং নেত্রকোনার বিভিন্ন উপজেলা ও ময়মনসিংহের গৌরীপুরে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।