গুম খুনের জবাব প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হবে: বি চৌধুরী

Badruddoza Chowdhury_DTগুম খুনের জবাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

রোববার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক গুম দিবস ২০১৪ উপলক্ষে গুম ও বর্তমান বাংলাদেশ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।

এসময় তিনি বলেন, র‌্যাব এতোগুলো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও র‌্যাবকে অকার্যকর করা হচ্ছে না। যতদিন পর্যন্ত গুম, খুনের বিচার না হবে ততদিন দেশের মানুষ শান্তিতে ঘুমাবে না। মানুষ সব সময় গুম আতঙ্কে থাকবে। আর গুম-খুনও কমবে না।

বি. চৌধুরী বলেন, ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতারা বড় বড় কথা বলছে। তারা এক অগণতান্ত্রিক সরকার গঠন করেছে। তারা কিভাবে গণতান্ত্রিক কথা বলবে। তাই নিজেদের রক্ষায় তারা নতুন নতুন আইন তৈরি করছে। তার বড় প্রমাণ বিচারপতিদের অভিশংসন।

বি চৌধুরী বলেন, র‌্যাবকে দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই। তারা হুকুম তামিল করে। এর জন্য দায়ী সরকার। এর জবাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দিতে হবে।

গতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে গুম খুনের বিচার করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ-র‌্যাব সরকারেরই অংশ। সুতরাং তারা যদি গুম, খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে।

র‌্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে বি. চৌধুরী বলেন, একদিন জনগণের সরকার পপ্রতষ্ঠিত হবেই। জনগণের সরকারকে গুম, খুনের বিচার করতে বাধ্য হবেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা বাধ্য করব।

তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীর সন্ধানের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার স্ত্রী দেখা করেছিলেন। সেসময় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিলেও ইলিয়াস আলীর সন্ধানে তার আন্তরিকতা দেখা যায়নি।

সাবেক এই রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আমার অবস্থান আমি জানি। এ কথার মাধ্যমে বুঝা যায় তিনি ভয়ে আছেন।

৫ জানুয়ারি নিবার্চন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনো ভোটার ভোট কেন্দ্রে যায়নি। ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিবার্চিত হয়েছেন। এ অগণতান্ত্রিক সরকারের কাছে আর কি আশা করা যায়। এই সরকার শুধু অগতান্ত্রিকই নয়, তারা গণতন্ত্র বিরোধী।

স্বজনহারাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজকে আপনাদের সঙ্গে আমিও মর্মাহত। এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে জাতীয় ও সরকারি কমিটি গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গুম, খুনের বিচার করা হবে।

বিএফইউজে’র সভাপতি শওকত মাহমুদ সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মিথ্যা দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করুন। জিয়াউর রহমান মুজিব হত্যায় গ্রিন সিগনাল দেননি।

সাত খুনের ব্যাপারে তিনি বলেন, অভিযোগের আঙ্গুল আপনার দিকে এই সাত খুনের দায় আপনাকে নিতে হবে। এই জন্য জনগণ আপনার কাছে বিচার চায় না তারা বিচার চায় আল্লাহর কাছে।

তিনি বলেন, এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলছেন। তাদেরও বিচার করতে হবে।

নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর লুনা বলেন, আমার শাশুড়ি তার ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে এখন মৃত্যশয্যায়। তিনি সব সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন মরার আগে যেন ছেলের মুখ দেখে যেতে পারেন। আমার ছোট্ট মেয়ে প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষায় থাকে তার বাবা ফিরে আসবে। আর আমার হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ, তা তো কাউকে দেখানো যায় না।

লুনা বলেন, ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে ইলিয়াসের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং বিয়ে। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। সব বিষয় আমার সঙ্গে শেয়ার করত ও। গুম হওয়ার কিছুদিন আগেও ইলিয়াস আমাকে বলেছিল, নানা রকম লিস্ট করা হচ্ছে। জানি না ভাগ্যে কি আছে। আমি ওকে সাবধান হতে বলেছিলাম। কিন্তু ও বলতো, ভয়ে ঘরে বসে থাকলে অধিকার আদায় হবে না।

তিনি বলেন, সাহসী ইলিয়াস সমূহ বিপদের কথা আঁচ করতে পেরেও টিপাইমুখ অভিমুখে লংমার্চ এবং টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আর সেটিই তার জন্য কাল হয়েছে।

লুনা বলেন, ইলিয়াস গুমের সঙ্গে সরকার বা সরকারি সংস্থা জড়িত না-এ প্রমাণের দায়িত্ব সরকারের। কারণ, রাত ১২ টায় ইলিয়াসের পরিত্যক্ত গাড়ি উদ্ধারের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি থানায় গিয়েছি। প্রশাসনকে জানিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়েছি। এত অল্প সময়ের মধ্যে একটা মানুষ হাওয়া হয়ে যাওয়ার কথা না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হলে ইলিয়াসকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো।

তিনি বলেন, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ফল ভোগ করব তা কখনো ভাবিনি। এক দশক আগেও গুম শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিতি ছিলাম না। এখন শুধু একটাই চাওয়া, আর কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়। আর কোনো সন্তানকে যেন তারা বাবার জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। আর কোনো স্ত্রীকে যেন দিনে পর দিন, রাতের পর রাত তার স্বামীর পথ চেয়ে বসে থাকতে না হয়।

এর আগে বক্তৃতা দিতে গিয়ে নিখোঁজ হাবিবুল বাশারের মা হোসনে আরা বেগম শুধু অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলেন। কিছুই বলতে পারেননি তিনি। তার কান্নায় মিলনায়তনের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। উপস্থিত অনেকের চোখ দিয়ে ঝরতে থাকে অশ্রু।

নিখোঁজ সুত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুর স্ত্রী তারান্নুম বেগম নুহাস কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তার একটিই দাবি- যে কোনো মূল্যেই হোক সরকার যেন তার স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়।

নিখোঁজ খালেদ হাসান সোহেলের স্ত্রী শাম্মী সুলতানার বক্তৃতায় কান্নার রোল ওঠে মিলনায়তনে। পাশে শিশু সন্তানকে বসিয়ে শাম্মী সুলতানা বলেন, প্রতি রাতেই আমরা ছেলে আমার কাছে জানতে চায় তার বাবা কোথায়। কখন ফিরবে সে?

তিনি বলেন, সংসারের বড় ছেলে হিসেবে আমার শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল আমার স্বামীর। আর আজ সন্তানসহ আমার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে বৃদ্ধ শ্বশুরের। এ যে কি কষ্ট সেটা বলে ে বোঝানো যাবে না।

নিখোঁজ চঞ্চলের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার ভাইকে যদি মেরে ফেলা হয় সেটা জানানো হোক। প্রতিদিন কান্নার চেয়ে আমরা একদিন কাঁদতে চাই।

তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক নিখোঁজ তারেকুল ইসলামের ঝন্টুর ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম মিথুনের আহাজারিতে বাকরুদ্ধ হয়ে যান মিলনায়তনের অনেকেই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাইফুল ইসলাম বলেন, বড় সন্তানকে হারিয়ে আমার মা এখন শয্যাশায়ী। মায়ের অসুস্থতার কারণে অচল হয়ে পড়েছে আমাদের সংসার।

নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমনের ছোট বোন ফেরদৌসী আরা বলেন, বড় ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর আমাকেই সব জায়গায় দৌড়াতে হয়েছে। কিন্তু কোনো জায়গা থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা পাইনি। ভাইয়ের রাজনৈতিক পরিচয় থাকায় জিডি করতে গেলেও তা নেয়নি পুলিশ।

সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন, সাবেক প্রধান নিবার্চন কমিশনার বিচারপ্রতি আব্দুর রউফ, এম এ আজীজ, ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, অধ্যাপক এ এম আজীজ, প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজু, ড. এম শামছুল আলম, এবি এম মোশাররফ হোসেন প্রমুখ।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend