সারাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে জাতির জনককে নিয়ে লেখা বিকৃত ইতিহাসের বই
দেশে ইতিহাস বিকৃতি যেন কিছুতেই থামান যাচ্ছে না। যুগে যুগে এ অপচেষ্টা চলেছে, এখনো সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সারাদেশের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর মাঝে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা বিকৃত ইতিহাসনির্ভর বই ছড়িয়ে পড়া এরই একটি প্রমাণ। দৈনিক জনকণ্ঠে বিভাষ বাড়ৈয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই এক তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিতর্কিত নোট ও গাইডবই প্রকাশনীর কথিত সৃজনশীল বাংলা সহপাঠ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীকে বিকৃত করে লিখেছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান শোষণমুক্ত স্বপ্নের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।’ বইয়ে অসংখ্যবার একই কথা লিখে প্রকাশনী সংস্থা বিক্রি করছে দেশজুড়ে। জাতির জনকের জন্মদিন সম্পর্কেও দেয়া হচ্ছে মিথ্যা তথ্য। রোববার এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ লেখা সংবলিত বই নজরে এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এ অপপ্রচারের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে শিক্ষা প্রশাসনে।
রোববার এবিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড বরদাশত করা হবে না। এসব অবৈধ নোট-গাইডের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসে। পদক্ষেপ নিলেও আবার তারা অপকর্ম করে। এবার আর ছাড় নেই। কিভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায় আমি দ্রুত আলোচনা করে পদক্ষেপ নেব। এরা জাতিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করবে, তা মানা যায় না। অপরাধের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জনকণ্ঠ তাদের প্রতিবেদনে জানায়, বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে যে আত্মজীবনী লেখার উদ্যোগ নেন, তা সংকলিত করে প্রকাশিত হয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
এই আত্মজীবনীর কিছু অংশ পাঠ্য হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে এবারের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যসূচীতে। বইটির সূচীপত্রে ২০ নম্বর গদ্যটি শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘বায়ান্নর দিনগুলো’ শিরোনামে। ১৩১ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখক-পরিচিতির অংশে বলা হয়েছে, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির জনক।’ পারিবারিক পরিচয় ছাড়াও ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ ও কারাবরণ, ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ করা, তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিরঙ্কুশ জয়লাভ, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এর কথা তুলে ধরা হয়েছে। ওই বছরের ২৫ মার্চ রাতে কারাবরণ ও এর আগে স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে দেশ গড়ার মহান দায়িত্ব গ্রহণ, প্রথম বাঙালী হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ প্রদান, ১৯৭৩ সালে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত হওয়ার কথা বলা আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার বিষয়ও উপস্থাপন করা হয়েছে লেখক-পরিচিতিতে। ‘বায়ান্নর দিনগুলো’র পাঠ-পরিচিতিতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে সংকলিত করা হয়েছে। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সহধর্মিণীর অনুরোধে তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজবন্দী থাকা অবস্থায় আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন। পরের বছর ১৭ জানুয়ারি আগরতলা মামলায় ঢাকা সেনানিবাসে আটক থাকায় লেখা বন্ধ হয়ে যায়।
পত্রিকাটি জানায়, অসাধু দুই নোট ও গাইড বইয়ের অপতৎপরতায় কপালে ভাঁজ পড়ার দশা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের। কারণ ইতোমধ্যেই সারাদেশের সকল বইয়ের দোকান ও কলেজের শিক্ষার্থীর কাছে চলে গেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা বিকৃত ইতিহাসনির্ভর নোট ও গাইড বই। পাঞ্জেরী পবলিকেশন্সের বাংলা সহপাঠ সৃজনশীল বইয়ের ১৯৯ নম্বর পৃষ্ঠার ৬৪ নম্বর প্রশ্নে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্ম তারিখ কবে? চারটি উত্তর লিখে বলা হয়েছে ২০ মার্চ। ১৭ মার্চের স্থলে ২০ মার্চ উল্লেখ করা হলেও চারটি অপশনের কোথাও সঠিক দিনটি লেখা নেই। সেখানে ১৭ সংখ্যাটিই নেই। লেকচার পাবলিকেশন্সের এইচএসসি বাংলা সহায়ক প্রথম পত্র বইয়ের ২৫৮ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম সায়েরা খাতুনের পরিবর্তে লেখা হয়েছে সাহেরা খাতুন। সবচেয়ে বড় অপকর্ম তারা করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় সম্পর্কিত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নিয়ে। যেখানে বঙ্গবন্ধু শোষণমুক্ত স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন সেখানে লেকচার পাবলিকেশন্স লিখেছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান শোষণমুক্ত স্বপ্নের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।’ লেকচারের এইচএসসি বাংলা সহপাঠ বইয়ের ২৬৪ থেকে শুরু করে অসংখ্য পৃষ্ঠায় এসব বিকৃত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ তথ্য দেয়া হয়েছে। অথচ পাঠ্য বইয়ে প্রশ্নটি আছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে মনে কী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন? বুঝিয়ে লেখ। প্রকাশনী সংস্থাটি কথিত এ সৃজনশীল বইয়ে লেখা আছে এটি এ প্লাস প্রাপ্তির নিশ্চয়তাসম্পন্ন ‘এক্সক্লুসিভ অনুশীলনমূলক বই’।
বইটির রচনাকারীদের স্থানে লেখা আছে ড. মোঃ মুস্তাফিজুর রহমান (সহকারী অধ্যাপক বাংলাদেশ ইউনিভর্সিিিট), ড. মনন অধিকারী (প্রভাষক অমৃতলাল দে মহাবিদ্যালয়, বরিশাল) এবং নাহিদ সুলতানার (সহকরী অধ্যাপক নারায়ণগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজ) নাম।
প্রতিবেদনে আরো জানান হয়, সম্পাদনা হিসাবে প্রকাশনী সংস্থাটি লিখেছে ‘সৃজনশীল মাস্টার ট্রেইনাল প্যানেল’। তবে জানা গেছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিষ্ঠানটি প্রচার করছে তাদের বই কেউ নকল করে এসব করতে পারে। প্রকাশনা সংস্থাটির এক কর্মকর্তা বলছিলেন, স্যার (মালিক) বিষয়টি দেখছেন। হয়ত কেউ নকল করেছেন। এ বিষয়ে আমি কোন কথা বলতে পারব না। এদিকে নিজেদের বইয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্ম তারিখ ভুল হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের কর্ণধার কামরুল হাসান শায়ক। তিনি দাবি করেন, এটা ভুল হয়েছে। সংশোধন করে ইতোমধ্যেই বই বাজারে দেয়া হয়েছে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ
– See more at: http://www.priyo.com/2014/09/01/102243a.html#sthash.v5LKBEyW.dpuf