আমাদের ছেলেমেয়েদের দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণা এবং অপমান: মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল নিয়ে দেশে তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সারাদেশে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার মতো ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দুইজনের বেশি নেই। বিষয়টি সংবাদপত্র খুব ফলাও করে প্রচার করেছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর অনেক বক্তব্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমি একমত নই; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ার মতো যোগ্যতা ১৬ কোটি মানুষের দেশে বলতে গেলে কারোরই নেই, এ ব্যাপারটিতে তিনি যা বলেছেন আমি মোটামুটিভাবে তার সঙ্গে একমত। আমি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখিনি, ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্য কী কী যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে, তার খুঁটিনাটিও জানি না। কিন্তু শুধু কমনসেন্স ব্যবহার করে খুব জোর গলায় বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার যোগ্যতা এ দেশে অনেক ছেলেমেয়েরই আছে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ে পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগে পড়ার মতো যোগ্যতা রাখে। আমি যদি তাদের খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে তার দায় দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের নয়, শিক্ষা ব্যবস্থারও নয়, তার দায় দায়িত্ব যারা খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের। আমরা সবাই জানি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অনেক সমস্যা আছে কিন্তু তার ভেতরে থেকেও অসংখ্য ছাত্রছাত্রী নিজের আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়া করে, হাজার প্রতিবন্ধকতা দিয়েও তাদের ঠেকিয়ে রাখা যায় না। তাই আমি যখন পত্রপত্রিকায় দেখি, সারা বাংলাদেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগে ভর্তি হওয়ার মতো ছাত্রছাত্রী দুইজনের বেশি নেই, আমি অত্যন্ত বিচলিত হই। আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের সারাদেশের সামনে হেয় করার এই দায়িত্বহীন প্রচারণা দেখে আমি ব্যথিত হই।
আমি মনে করি পুরো বিষয়টি ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করার জন্য হাইকোর্ট থেকে একবার আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল – আমি তখন তাদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি সেবার ভয়ংকর এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্রতিটি প্রশ্ন কোনো না কোনো গাইডবই থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করার কাজটি সহজ নয়। মান যাচাই করার পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন হয় এক রকম – ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছেঁকে নেওয়ার প্রশ্ন হয় সম্পূর্ণ অন্যরকম। ছেঁকে নেওয়ার প্রশ্ন দিয়ে মান যাচাই করার চেষ্টা করা কোনোভাবেই সঠিক নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে যত খুশি সমালোচনা করা যেতে পারে কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের দক্ষতা নিয়ে বা মান নিয়ে সমালোচনা করলে সতর্কভাবে করতে হবে। তাদের দায়িত্বহীনের মতো হতাশার পথে ঠেলে দেওয়া যাবে না। আমরা যারা পড়াই, প্রশ্ন করি, পরীক্ষা নিই – সবাই জানি ইচ্ছা করলেই এমনভাবে প্রশ্ন করা সম্ভব ছাত্রছাত্রীরা যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। ছাত্রছাত্রীদের আটকানো যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয় কাজটি পানির মত সহজ। আমরা কি সেটাই করতে চাই? আমরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার মান নিয়ে এত বড় বড় কথা বলি, সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান কোথায় সেটি নিয়ে যদি উল্টো ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন করে বসে, আমরা কি তার উত্তর দিতে পারব? আমরা তখন কোথায় গিয়ে আমাদের মুখ লুকাবো?
ভর্তি পরীক্ষার এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে আমার ভেতরে খুব আগ্রহ কি সম্মানবোধ কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। সংবাদপত্রগুলোকে আমি বহুদিন থেকে অনুরোধ করে আসছি, তারা যেন একবার এই ভর্তি প্রক্রিয়ায় (কিংবা ভর্তিবাণিজ্য যেটাই বলি) ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কত টাকা আদায় করা হয়, তার ভেতর থেকে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য নানা কাজে কত টাকা খরচ হয় এবং কত টাকা সম্মানী হিসেবে শিক্ষকরা ভাগাভাগি করে নেন, তার একটা তালিকা প্রকাশ করেন, তাহলে ভর্তি পরীক্ষা নামের এই ভয়ংকর অমানবিক এবং চূড়ান্ত অস্বচ্ছ বিষয়টি সবার সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সম্মিলিতভাবে একটা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা বহুদিন থেকে আলোচিত হয়ে আসছে। প্রকাশ্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তার বিরোধিতা করে না কিন্তু ঠিক সময়টিতে কেউ তার উদ্যোগ নেয় না। আমাদের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গত বছর একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, যুব ইউনিয়ন, জাসদ এ রকম বামপন্থি দলগুলো তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সেটি বিএনপি-জামায়াতের হাতে তুলে দেয় (যারা এই বাক্যটি পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের ঠাণ্ডা মাথায় আরও একবার বাক্যটি পড়ার অনুরোধ করছি)। পরীক্ষার দিন হরতাল ডাকা হবে এ রকম হুমকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দেওয়া হয়!
রাজনৈতিক দলগুলো যাই ভাবুক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভর্তি প্রক্রিয়ায় যত টাকাই উপার্জন করেন না কেন, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের নিয়ে যতই অহংকার করুক না কেন আমি মনে করি সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া হচ্ছে এই দেশের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার নামে অমানবিক যন্ত্রণা (এবং নূতন যোগ হওয়া অপমান) বন্ধ করার একমাত্র উপায়। এ ধরনের একটি প্রক্রিয়া কাজ করানোর জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তার প্রত্যেকটা ধাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে এবং কাজে লাগানো হয়েছে। প্রযুক্তিগত প্রত্যেকটা বিষয় সমাধান করা হয়েছে (অর্থ উপার্জন কমে যাবে বলে যারা বলেন এটা করা সম্ভব না, তাদেরকেও ভরসা দিয়ে বলা যায় তারা এই নূতন পদ্ধতিতেও যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে পারবেন!)
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত, তাই তারা কারও কথা শুনতে বাধ্য নয় – এতোদিনে আমি টের পেয়ে গেছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনোই নিজে থেকে এই ব্যাপারে এগিয়ে আসবে না!
আমার জানামতে এখন একটি মাত্র পথ খোলা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদেরকে ডেকে একটি নির্দেশ দেন যে সামনের বছর থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে, তাহলেই সেটি সম্ভব। তা না হলে সম্ভব নয়, ছাত্রছাত্রীদের বছরের পর বছর যন্ত্রণা, কষ্ট আর অপমান সহ্য করে যেতে হবে।
আমাদের ভাইস চ্যান্সেলররা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে মানেন না, শিক্ষামন্ত্রীর কথা শুনতে রাজি নন, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অবাধ্য হওয়ার সাহস মনে হয় তাদের কারোরই হবে না।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৯.৯.১৪