আনন্দের ঈদ, নিরানন্দের ঈদ- সোহরাব হাসান
ঈদ আসে। ঈদ চলে যায়। কারও কাছে ঈদ আসে আনন্দের সওগাত নিয়ে। কারও কাছে বেদনার বার্তা নিয়ে। ঈদ অনেকের কাছে মুনাফা অর্জনের মোক্ষম অস্ত্র। আবার অনেকে ঈদকে দেখেন আত্মশুদ্ধির ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যম হিসেবে।
ঈদকে সামনে রেখে প্রতিবারই একশ্রেণির চাঁদাবাজ, মাস্তান সক্রিয় হয়ে ওঠে। পশুর হাটে গরু নিয়ে আসতে গিয়ে যে ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজ ও মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হলেন, তাঁদের সান্ত্বনার কোনো জায়গাই থাকল না। তাঁরা এসেছিলেন আশা নিয়ে, ফিরে যাবেন একবুক বেদনা নিয়ে। রাষ্ট্র বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর জবাব কী? ঈদ উপলক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও বিভিন্ন হাসপাতালের সামনে পশুর হাট বসানো হয়েছে। পশুর হাট বসবে, বেচা-কেনা হবে। কিন্তু তা হাসপাতালের কাছেই হতে হবে কেন? কারা এসব অন্যায় করেন, তা নিবৃত্ত করার দায়িত্ব কি সরকারের নয়?
২.
এবারে যেসব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ঈদের আগে বেতন বোনাস পেয়েছেন, তাঁরা স্বজনদের সঙ্গে খুশি মনে ঈদ করতে পারবেন। কিন্তু যাঁরা ঈদের আগে বেতন-বোনাস পাননি, তাঁদের ঈদ হবে নিরানন্দ। যাঁরা বাড়ি যাওয়ার টিকিট পেয়েছেন, রাস্তায় যত ভোগান্তিই হোক স্বজনদের সান্নিধ্য তাঁদের বেশুমার আনন্দ দেবে। কিন্তু যাঁরা টিকিট পাননি, তাঁরা স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হবেন। ঈদের পুরো সময়টাই মন খারাপ থাকবে।
গত ঈদের মতো এবারও ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত তোবা গ্রুপের ১৬০০ শ্রমিক, যাঁরা বোনাস দূরের কথা, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের বেতনও পাননি। গত ঈদের আগে তাঁদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন মালিক দেলোয়ার হোসেন। কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেওয়ার নাম করে জামিন নেওয়া এই ভদ্রলোক জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসে কারখানাই বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দেননি। তোবা গ্রুপের ১৬০০ শ্রমিক কয়েক মাস ধরে তাঁদের বকেয়া মজুরি ও বোনাসের জন্য আন্দোলন করেছেন, অনশন করেছেন, মন্ত্রী ও বিজিএমইএর নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। গত শনিবারও তাঁরা বিজিএমইএ ভবনে ধরনা দিয়েছেন বেতন-বোনাসের দাবিতে। শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু তাঁদের কাছে কাকুতি মিনতি করে বলেছেন, অন্তত এক মাসের বেতন দেওয়া হোক। কিন্তু শ্রমিক নেত্রীর এই আকুতি কিংবা শ্রমিকদের আহাজারি বিজিএমইএর নেতাদের মন গলাতে পারেনি।
তাই, তোবা গ্রুপের ১৬০০ শ্রমিকের জন্য এবারের ঈদ কোনো আনন্দের বার্তা দিতে পারেনি। তাঁরা কবে বকেয়া বেতন-বোনাস পাবেন, তা-ও জানাননি। কেবল তোবা গ্রুপ নয়, আরও অনেক কারখানার শ্রমিক বেতন-বোনাস পাননি। শ্রমিকনেতাদের দাবি, ৭০ শতাংশ কারখানায় শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেওয়া হলেও ৩০ শতাংশ কারখানার মালিক তাঁদের বঞ্চিত রেখেছেন। কোথাও অর্ধেক বোনাস, কোথাও বা ১০/১৫ দিনের বেতন দেওয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় তাঁরা কী করে স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেবেন? তৈরি পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করে থাকলে ১০ লাখই পুরো বেতন-বোনাস পাননি।
৩.
তৈরি পোশাক খাতের বাইরেও হাজারো শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন-বোনাস দেওয়া হয় না। ঈদের আগেই মালিকদের নানা বাহানা শুরু হয়। তাঁরা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে ঈদের মার্কেট করলেও শ্রমিকদের বেতন দেন না।
ঈদের সময়ে যে পরিবহন খাত নিয়ে এত আলোচনা, সে খাতের শ্রমিকেরা দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও বোনাস পান না। অনেকেই ঘণ্টা ঠিকা কাজ করতে বাধ্য হন। একজন বাস বা ট্রাকচালককে দিনে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হলে তার মেজাজ ও শরীর দুটোই বিগড়ে যেতে বাধ্য। সড়কপথে অনেক দুর্ঘটনার কারণও চালকদের এই অতিরিক্ত পরিশ্রম। একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম, এক চালক বাসটিকে গন্তব্যে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আসনের পাশে ঢলে পড়েন। তখনও তাঁর হাতে স্টিয়ারিং ধরা। কখন যে তিনি হূদেরাগে আক্রান্ত হয়েছেন, জানতেও পারেননি।
লঞ্চের কর্মচারীদের বেতন আরও কম। সেখানে কোনো বেতন স্কেল নেই। বোনাস নেই। চাকরির নিশ্চয়তা নেই। মালিকের মর্জির ওপরই তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারিত হয়।
ঈদের দিনটিতে আমরা যেন এই স্বল্প বেতনের কর্মীদের কথা ভুলে না যাই। যেন ভুলে না যাই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী, গাড়ির চালক কিংবা বাসার গৃহকর্মীদের কথা, যাঁরা অহরাত্র আমাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পরিশ্রম করেন। আমরা যেন ভুলে না যাই ফুটপাতে, টার্মিনালে ও রেলস্টেশনে থাকা মানুষগুলোর কথা; যাঁরা সারা দিন পরিশ্রম করে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটান। তাঁরাও আমাদের মতো এই আলো ঝলমলে শহরে এসেছিলেন নিজেদের ভাগ্য বদলাতে। পারেননি। যাঁরা পেরেছেন, তাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে।
ঈদের দিনে আমরা যেন ভুলে না যাই রাস্তার পাশের উলঙ্গ শিশুটির কথা। আমার আপনার সন্তানের মতো সে-ও মানবসন্তান। আশরাফুল মখলুকাত। এই পৃথিবীতে তারও অধিকার আছে বেঁচে থাকার।