ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন আর নেই
ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গত শুক্রবার থেকে আবদুল মতিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তার রক্তচাপ ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ওঠানামা করছিল। ফলে চিকিৎসকরাও তাকে নিয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না।
গত ১৮ আগস্ট মস্তিস্কের একটি অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাষা মতিনের ব্রেইন স্ট্রোক করে। ওইদিনই তাকে রাজধানীর সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
১৯ আগস্ট সকালে রাজধানীর সিটি হাসপাতাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০ আগস্ট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মস্তিষ্কের জমাটবাঁধা রক্ত অপসারণ করা হয়। তখন থেকে তার অবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। ৮৮ বছরের এই ভাষা সংগ্রামী ডায়াবেটিস, রিকারেন্স হার্নিয়া ও প্রস্টেট গ্ল্যান্ডসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। ভাষা সংগ্রামী আবদুল মতিনের চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহন করে।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ও সংগ্রামী আব্দুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলায় এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে। তাঁর বাবার নাম আব্দুল জলিল এবং মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন তাদের প্রথম সন্তান।
১৯৩০ সালে গ্রামের বাড়ী যমুনায় বিলীন হলে আব্দুল জলিল জীবিকার সন্ধানে সপরিবারে ভারতের দার্জিলিংয়ে চলে যান। সেখানে জালাপাহারের ক্যান্টনমেন্টে সুপারভাইজ স্টাফ হিসেবে চাকরি পান।
১৯৩২ সালে দার্জিলিং-এর বাংলা মিডিয়াম স্কুল মহারাণী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হন। শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। ১৯৩৩ সালে আব্দুল মতিনের বয়স যখন মাত্র ৮ বছর, তখন তার মায়ের মৃত্যু হয় অ্যাকলামশিয়া রোগে।
মহারানী গার্লস স্কুলে ৪র্থ শ্রেণি পাশ করে ১৯৩৬ সালে দার্জিলিং গভর্মেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন মতিন। ১৯৪৩ সালে এনট্রান্স (Secondary Certificate Examination) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি।
ছেলে দার্জিলিংয়ে ভাল কোনো কলেজে ভর্তি হোক বাবা তা চাইলেও আব্দুল মতিন ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গভর্মেন্ট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ২ বছর পর ১৯৪৫ সালে তিনি এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আব্দুল মতিন ব্রিটিশ আর্মির কমিশন্ড র্যাঙ্কে ভর্তিপরীক্ষা দেন। দৈহিক আকৃতি, উচ্চতা, আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার বলে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান। এরপর তিনি কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর যান। কিন্তু ততদিনে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে তিনি একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (পাশ কোর্স) এ ভর্তি হন। ফজলুল হক হলে তাঁর সিট হয়। ১৯৪৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন এবং পরে মাস্টার্স করেন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস বিভাগ থেকে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলায় তার অবদান অন্যতম। ১৯৫২ সালে আব্দুল মতিনসহ অন্যরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। তারই নেতৃত্বে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সারা বাংলার জন্য আন্দোলনের নানা কর্মসূচি। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় ইমেজের অধিকারী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।
আব্দুল মতিন বেশ ক’টি বইও রচনা করেন। এগুলো হলো-‘ইউরোপের দেশে দেশে’ (১৯৬০), ‘কাস্তে’ (১৯৮৭), ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি’ (১৯৮৯), ‘প্রবাসীর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ’ (১৯৯১), ‘শামসুদ্দিন আবুল কালাম ও তার পত্রাবলী’ (১৯৯৮), ‘শেখ হাসিনা: একটি রাজনৈতিক আলেখ্য’ (১৯৯২), আত্মজীবনী ‘স্মৃতিচারণ পাঁচ অধ্যায়’ (১৯৯৫), ‘জীবনস্মৃতি: একটি বিশেষ অধ্যায়’ (২০১২), রাজনীতি বিষয়ক ‘জেনেভায় বঙ্গবন্ধু’ (১৯৮৪), ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়’ (১৯৯৩), ‘খালেদা জিয়ার শাসনকাল: একটি পর্যালোচনা’ (১৯৯৭), ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: মুক্তিযুদ্ধের পর’ (১৯৯৯), ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল’ (২০০৮), ‘বিজয় দিবসের পর: বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ (২০০৯), ইতিহাস বিষয়ক ‘রোমের উত্থান ও পতন’ (১৯৯৫), ‘মহানগরী লন্ডন’ (১৯৯৬), ‘ক্লিওপেট্রা’ (২০০০), ‘দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষবৃক্ষ’ (২০০১), ‘ভলতেয়ার: একটি অনন্য জীবনকাহিনী’ (২০০২), ‘কামাল আতাতুর্ক: আধুনিক তুরস্কের জনক’ (২০০৩), ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য’ (২০০৫), ‘ইউরোপের কথা ও কাহিনী’ (২০০৫); ‘ইউরোপের কথা ও কাহিনী’ (২০০৭), ‘ইউরোপের কথা ও কাহিনী’ (২০০৯)।