আরেকটি দুঃখের গল্প – কাকন রেজা
হুমায়ূন আহমেদ। ডক্টরেট করেছেন কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রিতে। যাকে বলে রসায়নের সংখ্যাতত্ত্ব। অত্যন্ত খটখটে ও কঠিন একটি বিষয়। তিনি অধ্যাপক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন এ বিষয়টি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক একটি বিশাল ব্যাপার।
কিন্তু একজন ড. হুমায়ূন আহমেদ এবং একজন লেখক হুমায়ূন আহমেদ এ দুজনের মধ্যে বিশালত্ব পরিমাপ করতে গেলে ড. হুমায়ূন আহমেদ লেখক হুমায়ূন আহমেদের কাছে নস্যি। যদি হুমায়ূন আহমেদ ডক্টরেট না করতেন কোন রকমে এলেবেলে করে পড়াশোনা সাঙ্গ করতেন তাতেও কিছু আসতো যেতো না। কারণ তিনি যে প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন তার পরিমাপ করার ডক্টরেট তো দূরের কথা কোন ডিগ্রীই এখন পর্যন্ত সৃজন করা সম্ভব হয়নি। তাঁর প্রতিভা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার দান করা। এ প্রতিভার সনদ প্রদানের সামর্থ্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।
হিন্দি ছবি আমি খুব একটা যে দেখি তা বলা যাবে না। পরিষ্কার ভাবেই বলি ভারতীয় সকল কিছুর প্রতিই আমার একটি অনিহা আছে। কারণ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আরো অনেক কিছু। অনেকে বলতে পারেন এটা অকারণ অনিহা- তারা বলুন। স্বাধীনতা অর্জনে শুরু থেকে আজ অবধি আমরা ওই দেশটির অবদান অকুন্ঠচিত্তে স্মরণ করেছি- করছি, বন্ধু বলে সম্বোধন করেছি। কিন্তু আমাদের অতি ভালোবাসার সেই সম্বোধন তাদের সম্মোহিত করতে পেরেছি কি না সেই প্রশ্নেই আমার সেই ‘অকারণ’ অনিহা।
তবে ‘থ্রি ইডিয়টস’ নামের ভারতীয় ছবিটি আমার মনোযোগ কেড়েছে অন্য কারণে। ছবিটি গতানুগতিকতার ধারাবাহিকতা ভেঙ্গে আলাদা একটি মেসেজ দিয়েছে আমাদের। ছেলেমেয়ে জন্মের পর থেকেই বাবা মা’গন উঠে পড়ে লেগে যান কিভাবে তাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানো যায় সেই প্রক্রিয়ায়। কিন্তু তাদের সন্তানদের ইচ্ছা কি- তাদের মেধার বিকাশ ঠিক কোন ক্ষেত্রে ঘটতে পারে- তারা মনের আনন্দে মজা নিয়ে কোন বিষয়ে কাজ করতে পড়তে আগ্রহী- তা না জেনে শুধু মাত্র অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নিয়ে বাবা মারা সন্তানদের সমস্ত আনন্দ মাটি করে অর্থ উপার্জনের নিশ্চিত মেশিন বানানোর প্রক্রিয়ায় নেমে পড়েন। আর ‘থ্রি ইডিয়টস’ বোঝাতে চেষ্টা করেছে পড়াশোনা হলো জ্ঞান অর্জনের জন্য- নিজের পছন্দের বিষয়- মনের আনন্দে শেখার জন্য- শুধুমাত্র ডিগ্রী অর্জনের জন্য নয়।
প্রতিটি মানুষেরই প্রায়শ কোন একটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ থাকে। সে বিষয়টিতে সে আনন্দ পায়। কেউ হয়তো ছবি একে আনন্দ পায়। সে মনের আনন্দে একের পর ক্যানভাস ভরিয়ে দিতে থাকে। ধরা যাক একজন বালক যে স্কুলের অংকের খাতায় আপন মনে পেন্সিল বা কলম যা পায় তাই দিয়ে ছবি আঁকে। তার ছবি দেখে চমকে যায় তার সহপাঠি। কারণ সে তার সহপাঠির মুখটি পেন্সিল স্কেচে চমৎকার তুলে এনেছে। তার এই আগ্রহের কাজটি প্রতিটি কাশেই সে করে আনন্দ পায়। তবে তার এ পছন্দের কাজটি করতে হয় খুবই সন্তর্পনে ‘চুপিচুপি’।
স্যারের হাতে যখন সেই অংকের খাতা পড়ে। তখন স্যার তো রেগে আগুন। অংকের মতো বিশাল একটি ব্যাপারকে নিয়ে হাসি তামাশা। অংকের খাতায় গাধার ছবি। এই ছেলে তো একটি গাধা। না হলে অংকের খাতায় এমন নিখুঁত গাধার ছবি আঁকবে কেনো! তার মা বাবাকে জানাও এই ছেলে পড়াশোনায় মনোযোগ নেই। কাশে বসে অংকের খাতায় ছবি আঁকে। একে দিয়ে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং হবে না। মা বাবাও রেগে আগুন এতবড় স্কুলে দেয়া হয়েছে। বাসায় টিচার এসে পড়িয়ে যায়। মাসে মাসে গাদা গাদা টাকা খরচ যায় ওই ছেলের পেছনে। আর সে কি না কাশে বসে খাতায় গাধার ছবি আঁকে- কি সর্বনেশে কথা!
ছাত্র ও পুত্রের খাতায় আঁকা ছবিটির গাধা যে স্বয়ং তারাই ‘শিক্ষক ও মা বাবা’গন কি তা বুঝতে পারেন?
২
দৈনিক মানব জমিন- এ কদিন আগে হুমায়ূন আহমেদের ভাই জাফর ইকবাল ‘একটি দুঃখের গল্প’ নামে চমৎকার একটি লিখা লিখেছিলেন। ভুল হলো হুমায়ূন আহমেদের ভাই হলেও এই ভদ্রলোকের নামের আগে প্রায়ই ডক্টর পদবিটি জুড়ে থাকতে দেখা যায় হয়তো তিনি তা দেখতে পছন্দও করেন। জনাব ডক্টর জাফর ইকবাল এ জীবনে খবরের কাগজের জন্য যেসব লিখা লিখেছেন এ লিখাটি ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম।
তার লিখায় মানব জমিন অনলাইনে একজন কমেন্ট করেছেন অনেকটা এরকম ভাষায়, স্যারের সব লেখায় তথ্য ও যুক্তি থাকে কিন্ত এ লিখাটিতেই দেখলাম তার সাথে বিবেকও যোগ হয়েছে।
ড. জাফর ইকবাল তার এ লিখাটিতে বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থার’র ভয়াবহ দিকটি ঝকঝকে বর্ণনায় তুলে ধরেছেন। আমাদের দেশে একশ ভাগ পাশের যে সর্বনাশা খেলা শুরু হয়েছে সেই খেলার মাশুল দিতে হচ্ছে আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের। কার বা কাদের মাথা থেকে এমন উদ্ভট চিন্তা এলো যে পাশের হার একশ ভাগ করতে হবে। কি কিম্ভুত আর ভয়াবহ চিন্তা। দেশের এমন ‘মারাত্মক’ উন্নতির চিন্তা যারা করলো তাদের চিন্তায় সবাই সায় দিলেন কি করে। দেশের এতো এতো নেতা, পাতি নেতা, সমুদ্র সমান কিংবা পুকুর সমান বুদ্ধির অধিকারী বুদ্ধিজীবীগন কি করে চুপ থাকলেন!
সৃজনশীল পদ্ধতির অন্যতম রূপকার অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ’কে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে- আপনি যে পদ্ধতির সৃজন করেছেন তা যে কতটুকু বিপথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা কি আপনি অনুভব করতে পারছেন? আপনার মতো মানুষের তো চুপ করে থাকার কথা নয়- সারাজীবন আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য কাজ করেছেন- শতভাগ পাশের নামে শিব গড়তে যে বাদর গড়া হচ্ছে তা কি আপনার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে- একটি দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে যে ভাবে ধ্বংস করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা দেখেও কি আপনার মতো মানুষেরা চোখ বুঁজে থাকবে!
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের ‘সুশীল সমাজ’ উটপাখির চিন্তা অনুসরণ করছেন। অর্থাৎ নিজের মুখ বালিতে ঢেকে রাখছেন- আমি দেখছিনা- অতএব কিছুই হচ্ছে না- ভাবটা অনেকটা এরকম। কিন্তু তারা না দেখলেও ক্রমান্বয়ে ভিত ধ্বসে পড়ছে- আমরা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি ভয়াবহ এক ট্র্যাজেডির দিকে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।