শিয়া সুন্নি বিরোধের মার্কিন ইতিহাস এবং আমরা যা জানিনা বা জানতেও জানিনা এবং জানতে হবে তাও জানিনা
ফক্স নিউজ না, বিগত কয় এক মাসে সিএনএন বিবিসি সহ আরো অনেক নরম পন্থি পশ্চিমা নিউজ পোর্টালে ইরাকে শিয়া সুন্নি বিদ্বেষের ইতিহাস নিয়ে অনেক লেখা পড়লাম। এবং সেই ইতিহাস এবং সুন্নি টেরোরিজম সালাফিজম, ওয়াহাবিজম কিভাবে বর্তমানে এই আইসিস এর সৃষ্টি করছে এবং ইসলামিক টেরোরিজমের উৎসের সন্ধানে এইসব লেখা গুলো থেকে এইটা বোঝা গেলো, একজন শিয়া এবং একজন সুন্নি পাশাপাশি পেলে একজন আরেক জনকে খুন করবে, এটা হইলো আরবের বাস্তবতা। এই লেখা গুলো পড়লে আপনি বুঝবেন এই ঐতিহাসিক ঘৃণাই আজকে ইরাক সিরিয়ার সকল সমস্যার উৎস। সারা দুনিয়া এখন সেই ভাবে জানে।
আমার এক বন্ধু বুঝালো,
ইরাকের ১৯ শতকের আব্দুল আজিজ এবং আব্দুল ওয়াহাবের হাতে বসরাতে কয় এক শ শিয়া খুন হয়। সেই থেকে ইরাকের শিয়া সুন্নিদের আধুনিক দ্বন্দের সূচনা।
কিন্তু, আমাদের নিজের দেশের প্রেক্ষাপটে ভাবতে গিয়ে দেখলাম, ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান দ্বন্দের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। একদম মডার্ন টাইম হিসেবে করলেও আমরা দেখি, পার্টিশনের পূর্বে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গায় বেশ কয়েক এক হাজার হিন্দু মুসলমান একে অপরের হাতে খুন হয়। কলকাতায়, নোয়াখালীতে উল্লেখযোগ্য মাসাকার হইছে, উভয় সম্প্রদায়ের । এমনকি সাম্প্রতিক কালের বাবরি মসজিদের ঘটনায় ভারতে, প্রায় হাজার দুই এক মুসলমানকে হত্যা করা হয় এবং বাংলাদেশও অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ খুন হয় তার পরে পরেই।
কিন্তু এর মানে কি ভারতে, বা বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমান একই সাথে শান্তিপূর্ণ ভাবে বাস করছেনা ? এবং আমরা এও দেখছি, বিগত ভারতীয় নির্বাচনে, মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত, নরেন্দ্র সিং মোদীকে ৮% মুসলমান ভোট দিয়েছে। (http://www.bbc.com/news/world-asia-india-27615592)
রক্তপাতের ইতিহাস তো আমাদের এই অঞ্চলেও আছে, তাহলে, আমাদের এখানে পারলে, ইরাকে কেন পারবেনা?
ঘাটতে ঘাটতে গিয়ে একটা সাক্ষাতকার পেলাম।
এই লোকটার নাম, প্রফেসর হাদ্দাদ। ইনি ন্যাশনাল ইউনিভারসিটি অফ সিঙ্গাপুরের, মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ-এর একজন রিসার্চ ফেলো। উনার ইন্টারভিউয়ার, প্রফেসর হাদ্দাদের সাক্ষাতকার নেয়ার সময়ে যেই উত্তরে অবাক হয়েছেন এবং বার বার সেখানে ফিরে আসছেন, আমিও সেই জায়গায় বার বার থামলাম।
প্রফেসর হাদ্দাদ এক পর্যায়ে বলছিলেন, ২০০৩ সালের আগে ইরাকে সুন্নি আইডেন্টিটি বলে কোন ডমিন্যান্ট আইডেন্টিটি ছিলনা। সেটা কী ছিল? উনি বললেন সেটা ছিল, ইরাকি আইডেন্টিটি। উদাহরণ হিসেবে উনি দেখালেন, যেমন একজন সাদা আমেরিকান যেভাবে, ক্যাথোলিক আমেরিকান বা প্রটোস্ট্যান্ট আমেরিকানের বদলে পরিচয়ের জায়গায় হোয়াইট আমেরিকান হিসেবেই পরিচিত হয়, ঠিক সেভাবে ইরাকেও সুন্নিদের সেভাবে ধর্মীয় পরিচয়টা ডমিন্যান্ট ছিল না। তারা ইরাকি হিসেবেই পরিচিত ছিল।
তার সাক্ষাৎকারের এই অংশটা আমি আক্ষরিক অনুবাদ করছি।
মুল সাক্ষাৎকার এখানে http://www.vox.com/2014/6/20/5827046/who-are-sunnis-who-are-shias
প্রশ্নকর্তা: আপনি কী মনে করেন, বর্তমান গোত্র বিদ্বেষ, কিভাবে ইরাক রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের ভাবনাকে প্রভাবিত করে? শুধু মালিকি সরকার নয়, পুরো রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের এটিচ্যুড কি?
হাদ্দাদ: আমি মনে করি, ২০০৩ ইরাকের একটা গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই বছরের পূর্বের এবং পরের ইরাকের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। এবং আজকে যা হচ্ছে, সেটাতে ২০০৩ এর ব্যাপক ভূমিকা আছে।
২০০৩ যখন আসছে, অনেক শিয়া এবং নিঃসন্দেহে অনেক কুর্দি তাকে স্বাগতম জানাইছে। তারা দেখছে, এর মাধ্যমে তারা তাদের শিয়া এবং কুর্দি পরিচিতি ফিরে পেয়েছে। একই সাথে তারা মনে করছে তারা তাদের নিজস্ব ইরাককেও তারা ফিরে পেয়েছে। অন্য দিকে, সুন্নিদের জন্যে এইটা সেই রকম কোন সেন্টিমেন্ট ছিল না, কারন ২০০৩ এর পূর্বে, ইরাকে সুন্নি বলে আলাদা কোন পরিচিতি ছিলনা বললেই চলে ।
এখন আপনি যা দেখছেন সেটা সম্পূর্ণ উল্টো। কারন, ইরাকি সরকার একদমই জনপ্রিয় নয়। কারো কাছেই না। আমি বলবো, ইরাকি শিয়ারা হয়তো এখন এই সরকার বা রাষ্ট্রকে মেনে নিচ্ছে বা কিছুটা হইলেও বৈধ মনে করছে । কিন্তু, ইরাকি সুন্নিরা এই সরকারকে কোন মতেই বৈধ মনে করছেনা।
এর থেকে আপনি বুঝতে পারবেন, ইরাকের কিছু অংশে বর্তমানে কি হচ্ছে। এটা সব ক্ষেত্রেই ধর্মীয় উগ্রপন্থার প্রশ্ন না। অনেকে আছে যারা এই সরকার বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনকে একটা রেভ্যুলিশান হিসেবে দেখে। তারা সরকারের পক্ষে, আর্মিতে কাজ করার কথা চিন্তাও করতে পারে না, কারন তারা বর্তমান ইরাক সরকারকে বৈধ মনে করেনা।
প্রশ্নকর্তা: আমার মনে হয়, ইরাকের সুন্নি আইডেন্টিটি ২০০৩ এর আগে না থাকার বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং। আপনি এটা আরো একটু ব্যাখ্যা করবেন, কিভাবে না থাকা সেই সুন্নি আইডেন্টিটি ফর্ম হলো?
হাদ্দাদ: সুন্নি আইডেন্টিটির যে তুলনা আমি করেছি সেটা সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের জন্যে প্রযোজ্য। মনে করেন, ইংল্যান্ডে কালো মানুষ (বা আমেরিকান কালো মানুষ) তাদের যেই রকম কালো মানুষ পরিচয়ের একটা কালেক্টিভ চেতনা আছে, ইরাকের সুন্নিদের তাদের সেই সুন্নি পরিচয় থেকে আসা কালেক্টিভ চেতনা ছিলনা।
আমার বক্তব্য হলো ইরাকি সুন্নিরা নিজেদেরকে আলাদা ভাবে সুন্নি হিসেবে দেখতো না। তারা নিজেদের ইরাকি হিসেবে দেখতো।
(আমাদের নিজেদের সাথে একটা তুলনা করে বলি, বেশীর ভাগ বাঙালি মুসলমান সুন্নি। কিন্তু বাঙালি মুসলমান নিজেকে সুন্নি মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয় না, শুধু মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয় । কারন তার সুন্নি মুসলমানের কোন গুরুত্বপূর্ণ আলাদা উপাদান তার মধ্যে আলাদা ভাবে নাই, যা আছে তার মুসলমান পরিচয়ের মধ্যেই সেইটা প্রোথিত। যাক, ইরাকে সেটা কিভাবে ফর্ম হলো সেটা নিয়ে ইন্টারেস্টিং কিছু কথা এখনি বলবেন, প্রফেসর হাদ্দাদ। )
কিন্তু, ২০০৩ ছিল তাদের জন্যে বড় একটা ধাক্কা। কারন সেই সময়ে তারা দেখতে পেলো, শিয়াদের মধ্যে চাপা পরা আত্মচেতনা ছিল যা আগে দেখা যায়নি। এমন না যে, সেই আত্মচেতনা কোন ক্ষতিকর বা আক্রমনাত্নক ছিল, কিন্তু শিয়াদের মধ্যে যে ইরাকি পরিচয়ের বাহিরে এই ধরনের এত ডমিন্যান্ট আত্মচেতনা ছিল সেটা হঠাৎ করে আবিষ্কার করে সুন্নিরা অবাক হয়েছে।
আবার বলছি, আন্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে এটা আপনাকে দেখতে হবে। সুন্নিরা কখনই তেমন চিন্তিত ছিলনা বা জানতো না যে, ইরাকের মধ্যে আন্ত সাম্প্রদায়িক সম্পর্কে এই ধরনের চাপা ইস্যু আছে। তারা নিজেরাও নিজেদেরকে আন্ত সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের কারনে বলী হওয়া জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখত না। এই খেলা গুলো শুরু হয়েছে ২০০৩ এর পর থেকে।
আরো একটা বিষয় হইলো, ২০০৩ এর পরে তাদেরকে একটা সুন্নি পরিচয় সৃষ্টি করতে হইছে, কারন তারা চায় কি না চায় সিস্টেম চাইছে তাদেরকে এখন সুন্নি পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। ইরাকের তখনকার সিস্টেম (মার্কিন প্রশাসনের চালিত সিস্টেম) চাইছে, ইরাকের পলিটিক্সের মুল বিভাজনগুলো হবে সম্প্রদায়ের পরিচয় ধরে। তাই তাদেরকে সুন্নি পরিচয়ের মাধ্যমে নিজেদের আইডেন্টিটি খুঁজে নিতে হইছে।
এখন কিন্তু বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। কারন, এখন একটা শক্ত সুন্নি পরিচয় জন্মেছে। এবং এই পরিচয়ের ভিত্তি হইলো, তারা মনে করে সুন্নি হিসেবে তারা অন্যায়ের শিকার হয়েছে।
এটা আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল। ইরাকে বর্তমানে শিয়া মেজরিটি সরকার। যে সব সময়ে বলে বেড়ায়, যে সংখ্যা গুরু হয়েও কিভাবে তারা নিপীড়িত হয়েছে। এটার একটা প্রভাব হইলো, এর ফলে সুন্নি হিসেবে সে নিজেকে এটার বহির্ভূত মনে করে । তাই এটা তাদের জন্যে খুবি স্বাভাবিক যে, তারা এখন ২০০৩ সালে সৃষ্টি হওয়া সাম্প্রদায়িক বিভাজনের লাইন ধরে, নিজেদের পরিচয় খুঁজে নেবে।
এবং এটা বিগত ১১ বছরে, আরো বৃদ্ধি পাইছে। এখন তাই খুব শক্ত সুন্নি পরিচয় জন্মাচ্ছে সুন্নিদের মধ্যে, যার ভিত্তি হলো, তাদের নির্যাতিত হওয়ার বোধ। এবং সংখ্যা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব এই খানে একটা রোল প্লে করে। আমি বলেছি, সুন্নিরা এখন দেখে যে, তাদেরকে রাষ্ট্র সংখ্যালঘু পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং সংখ্যা গুরুর হাতে সংখ্যা লঘুর নির্যাতনের ভাবনাটার একটা বড় প্রভাব রয়েছে। এটা জাতীয়তার বাহিরে গিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করে, যা তার সুন্নি হিসেবে নির্যাতিত হওয়ার বোধ থেকে সুন্নি হিসেবে আত্ম পরিচয়কে আরো মজবুত করেছে ।
পাঠক ভুল পড়বেন না। এখানে সুন্নি ভিকটিমহুডকে হাইলাইট করা হয়নি। এখানে আমি দেখাতে চায়েছি, ২০০৩ শালে ইরাক আক্রমণের পরে, ইরাকে মার্কিন পলিসিগুলো কিভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজনটাকে সৃষ্টি করছে।
এবং শিয়া সুন্নির দীর্ঘ সংঘর্ষের ইতিহাস দেখিয়ে এখন যেই ভাবে, পুরো প্রচার যন্ত্র এবং তার প্রভাবে আমরা নিজেরাও সালাফিজমের প্রভাব, সাফাভিডদের প্রভাব, ওয়াহাবিজমের প্রভাব সহ ইত্যাদি গল্প করি এবং ইরাকের বর্তমান যুদ্ধকে একটা ধর্মযুদ্ধ বা ধর্মীয় পরিচয়ের যুদ্ধ মনে করি, সেই যুদ্ধটা কিভাবে মান্যুফাকচার করা হয়েছে।
এটা এখন আসলেই তাই। এবং ২০০৩ সালের পূর্বে ইরাক খুব শান্তিপূর্ণ জনগোষ্ঠী ছিল সেটাও আমি বলছি না।
সুন্নি শিয়ার সামাজিক অবস্থান আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ। কারন, একটা রাষ্ট্রে দু’টা গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দের মুল জায়গা আসে, সমাজ থেকে।
এবং সামাজিক অবস্থান থেকেও আপনি দেখবেন, ইরাকের সুন্নি শিয়ারা তেমন কোন দ্বন্দপূর্ণ অবস্থা গ্রহণ করতো না একে অপরের বিরুদ্ধে ।
এটা আমরা বুঝতে পারি, যখন আমরা দেখি ইরাকে গণহারে সুন্নি শিয়া বিয়ে হয়। অনেক গোত্র আছে যার মধ্যে অর্ধেক সুন্নি অর্ধেক শিয়া। অনেক ফ্যামিলির বাবা সুন্নি মা শিয়া। এইটা ইরাকের সাম্প্রদায়িক ডাইনামিকস। কিন্তু আমাদের দেশে বা ইন্ডিয়াতে হিন্দু মুসলমান বিয়ের কোন প্রশ্নই আসেনা।
২০০৩ সালে মার্কিন আক্রমণের পরেই, আমরা শুনতে থাকে, শিয়া সুন্নি বিরোধের কথা । কারন, এইটা ইরাক আক্রমণের পর থেকেই মার্কিন ডিভাইড এন্ড রুল সিস্টেমের প্রধান উপাদান ছিল, যা সকল পাশ্চাত্য আলোচনায় ডমিনেট করেছে। মার্কিনীদের প্রধান উদ্দেশ্যে ছিল, শিয়া সুন্নির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করার লাইন। এই গুলো খুব প্লান করে ম্যানুফাকচারড। এই ম্যানুফাকচারিং প্রসেসটাই আপনি প্রফেসর হাদ্দাদের উত্তরে পাবেন।
এবং একটা গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় অংশ গ্রহণে কোটি কোটি ডলারের তেল ব্যবসায় সুবিধা দেয়া না দেয়ার মাধ্যমেও এই কাজ গুলো মার্কিন বাহিনী করছে।
ইরাক যুদ্ধের পরে পরে, আমি একটা লেখা পরেছিলাম যা আমার দাগ কেটেছিল।
একজন ইরাকি বলেছিলেন যে, আমি যেই বন্ধুদের সাথে ঘুরতাম আড্ডা দিতাম, বাসায় দাওয়াতে খেতে যেতাম- আমার জানাই ছিলনা, কে শিয়া কে সুন্নি।
রেফারেন্সটা এখন দিতে পারবোনা কিন্তু, এর থেকে বোঝা যায়, ইরাকে বর্তমানে শিয়া সুন্নি দন্দের যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বার বার ওয়েস্টার্ন মিডিয়াতে আসছে সেইটা ম্যানুফাকচারড দ্বন্দ্ব।
অনেকে বলবেন, আরে ভাই সাদ্দাম হোসেন ছিলেন, সুন্নি তাই, ওই আমলে সুন্নি ডমিনেন্স ছিল।
হতে পারে। কিন্তু, আমাদের জেনে রাখা দরকার। বাথ পারটি চরম সেকুলার একটা পারটি ছিল। এই ইডিয়লজির জনক আলাবী জাকি আল আরসুজি এবং ক্রিস্টিয়ান শিক্ষক মিশেল এফ্লেক| দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার সময় পুরো আরব অঞ্চলে কলোনিয়াল শাসন থেকে মুক্তির যে সংগ্রাম চলছিল সেই সংগ্রাম এ আরব জাতীয়তা এবং সমাজতন্ত্রের মিশ্রণ ঘটিয়ে বাথিযম এর আইডিয়ার জন্ম নেয় |
আরব জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সেকুলার শাসন ব্যবস্থা, বাথিযম এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও বাথিজম আরব ন্যাসনালিজ্ম এর একটা অংশ হিসেবে ইসলামিক অনুশাসন এবং ইসলাম ধর্মকে এই মুভমেন্ট এর একটা প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বাথিযম এর প্রধান প্রবক্তা মিশেল এফ্লেক তার লেখায় আরব থেকে ইসলাম এর জন্ম এবং বিশ্বব্যাপী আরবদের হাত ধরে ইসলাম এর আত্মিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক বিজয় অর্জন করাকে আরব জাতীয়তাবাদ এর আধিপত্য হিসেবে দেখিয়েছেন।
আর ক্ষমতা যেখানে স্বৈরাচারে পরিণত হয় তখন স্বজন প্রীতি হয় অন্যতম উপাদান। কিন্তু, সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে শিয়া সাপ্রেসান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা। সাদ্দামের অনেক ব্যাটালিয়ন ছিল শিয়া যোদ্ধাদের সমন্বয়ে , যারা ইরাক ইরান যুদ্ধ করছে।
সাদ্দাম হোসেন যে সুন্নি এবং সেই আমলে শিয়া টর্চার হোতো এইটা, ইরাক যুদ্ধের আগে তেমন আসে নাই। সাদ্দাম কুর্দিদের উপর অত্যাচার করছে সেই আলোচনা ছিল। কিন্তু, সাদ্দাম ছিল কড়া সেকুলার। কিন্তু সাদ্দাম পরবর্তী ইরাকে, শিয়া সুন্নি বিভাজনটা ছিল, মার্কিন পলিসির প্রধান টেকনিক।
(বাথিজম এবং সিরিয়ার যুদ্ধের ঐতিহাসিক কন্টেক্সট জানতে পড়তে পারেন, আমার এই দীর্ঘ রচনাটি । http://goo.gl/lB20Ia )
আমার এই যুক্তি এই গুলো দিয়ে আইসিসকে জাস্টিফাই করা হচ্ছেনা।
আইসিস যে কি ব্রুটাল সেই বিষয়ে, আমরা আসবো। আগামী লেখা গুলোতে যদি সুযোগ পাই ধৈর্য থাকে, কিন্তু, আমরা দেখবো তারা তাদের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার করার জন্যে কি ভাবে, নৃশংসতার আশ্রয় নিয়েছে।এবং ইসলামের নামে তারা যা করছে তা কোন মতেই সমর্থনীয় নয় এবং এদের বিরুদ্ধে আমাদের কড়া অবস্থান নিতে হবে। এই নিয়ে আগামীতে আর লেখার ইচ্ছা আছে।
বরং, আমরা এই উপসংহারে পৌছুতে পারি, ২০০৩ সালে যেই স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকা ইরাকে সুন্নি শিয়া বিভাজন করছিল, আইসিস সেই প্ল্যানের একটা সফল বাস্তবায়ন। কারন, আমেরিকার জন্যে আইসিসের থেকে চমৎকার শত্রু হয় না। আগের একটা লেখা কোট করে বলি,
একটা শত্রু, যার আমেরিকার বুকে আঘাত করার কোনো সক্ষমতা নাই, কিন্তু ঠিকই হোম গ্রউন টেররিস্টের ভীতি সৃষ্টি করে দেশের পলিটিক্সে এন্টি ইসলামিক গেম খেলা যাবে। একটা শত্রু যার ভিন-ধর্মীদের উপরে আক্রমণ এবং গলা কাটার ভিডিওগুলো দেখিয়ে, মধ্যপ্রাচ্যে আরো একটা আগ্রাসন এবং আক্রমণ করার যুক্তি দেয়া যায়। এই শত্রুটির কার্যক্রম এত নৃশংস যে, বিশ্ব জনমতের একটা বড় অংশ মার্কিন আক্রমণের পক্ষে থাকে, যেখানে আমেরিকার ওয়ার অন টেররের নামে, প্রথম আক্রমণে আমেরিকাকে তাদের স্যাটেলাইট, মিডিয়া, আর্থিক ক্ষমতা হইতে শুরু করে দস্তা দস্তা কাগজ ব্যবহার করে প্রমাণ করতে হইছে, ইরাকে জন-বিধ্বংসী অস্ত্র আছে, যা তারা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায় নাই—(কারণ সেইটা কখনো ছিলনা) ফলে আমেরিকা মিথ্যুক এবং প্রতারক সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত হইছে। কিন্তু আমেরিকার বিরুদ্ধে এভাবে চিহ্নিতকরণের বিপদ এবার আইসিসের কারণে হয় নাই।
পুরো ইউরোপ এবং আমেরিকাতে যে ইসলাম এবং মুসলিম বিদ্বেষ রয়েছে তা ন্যায়সঙ্গত করার জন্যে নিয়মিত বিরতিতে যথেষ্ট পরিমাণ কল্লাকাটার ভিডিও তৈরি করছে এই শত্রুরা। এটা হল এমন এক শত্রু—মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, সউদি আরব ও কুয়েতের মতো আমেরিকার এসব বন্ধু-দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অস্ত্র কেনার জন্যে এবং তাদের ভেতরে মার্কিন সেনা ক্যাম্প রাখার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ ভয়ভীতি জারি করে রাখা যায়। মানে আইসিসের মতো শত্রু তৈরি করার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিতিশিলতা সৃষ্টি করে বিপি, শেল, কনকোফিলিপ্সসহ বিভিন্ন মার্কিন এবং ইউরোপিয়ান তেল কোম্পানির জন্যে তেলের দাম অনায়াসে এমন একটা পর্যায়ে রাখা যায়, যাতে তাদের ভালো মুনাফা ধরে রাখা যায়। আবার এই দাম এমন একটা পর্যায়েও যেন চলে না যায়, যাতে পশ্চিমা বিশ্বের ঘরোয়া অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়ে।
কিন্তু সাফল্যের সাথে, আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান এসটাব্লিশ্মেন্ট আজ সাফল্যের সাথে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিয়েছে ইসলামের দিকে। সারা বিশ্বের মুসলমানদেরকে আজে প্রমাণ করতে হচ্ছে, আইসিসের মত সেও টেররিস্ট নয়।
এই জন্যে , আমাদের বার বার এডওয়ার্ড সায়িদের কাছে ফিরে যেতে হবে,
“১৮ শ শতকের শেষ দিকের একটা সময়কে শুরু হিসেবে দেখলে, ওরিয়েন্টালিজম কে আমরা দেখতে পারি পারি , একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে প্রাচ্যকে মোকাবেলা করে এমন ভাবে যেন সে, প্রাচ্য সম্পর্কে আলোচনার ভাষা তৈরি করে দেয় এবং এই সম্পর্কে মানুষের কোন অবস্থানটা গ্রহণ যোগ্য হবে তার অনুমতি দেয় এবং এই সম্পর্কে কি ভাবতে হবে, কি ভাবে শিখতে হবে, কি ভাবে এই জায়গা দখল করতে হবে এবং কিভাবে শাসন করতে হবে, তা নির্ধারণ করে দেয়।“
আজকে যখন আমরা দেখি, আমেরিকার সৃষ্ট এই ভাত্রি ঘাতী যুদ্ধ যাতে প্রতি মাসে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, গৃহচ্যুত হচ্ছে, স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা ধ্বংস হচ্ছে এবং একটা পুরো জাতি এবং জনপদ হারিয়ে যাচ্ছে এবং এর পরে যখন দেখি, ইসলামিক টেরররিজম হয়ে ওঠে প্রধান ইস্যু তখন, একটা কথাই বলতে হয়, ব্রাভো।