ঈদ বিতর্ক: হেরেছে সৌদি জিতেছে চাঁদ
সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশে ঈদ উদযাপন করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা থেকে এ রায় এসেছে। একই দিনে সারা পৃথিবীতে (সৌদি আরবের সঙ্গে) একই সঙ্গে ঈদ-সিয়াম পালন শিরোনামে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া গোষ্টা মার্কাস মসজিদে এ বিতর্ক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
শুক্রবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আহলে হাদীস অনুসারী দু’পক্ষ এমন বিতর্কে অংশ নিয়ে কোরআন-হাদীসের আলোকে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। বিতর্কে বাংলাদেশে চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু ও ঈদ উদযাপন পক্ষের দল জয়ী হয়। বিতর্কে যারা হারবে তারা প্রতিপক্ষের নিয়ম মোতাবেক ঈদ করবে বলে বিতর্কের আগে এক অঙ্গীকারনামায় দু’পক্ষের সদস্যরা স্বাক্ষর করেন।
জমজমাট এ বিতর্ক শেষে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়, অঙ্গীকারনামার লঙ্ঘন করে দেশের কোথাও যদি ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটে তবে কোরআন-হাদিস ও সরকারের সংবিধানের পরিপন্থীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হবে।
বিতর্কের আয়োজক স্থানীয় দাপুনিয়া গোষ্টা মার্কাস মসজিদ কমিটির সদস্যরা জানান, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের সঙ্গে সিয়াম শুরু ও ঈদ করার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। কোন পক্ষ ঠিক আর কোন পক্ষ ঠিক না এ নিয়েও চলে আসছে বিতর্ক।
এসব বিতর্কের অবসান ঘটাতেই আহলে হাদীস অনুসারী দু’পক্ষ নিজেদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। সেই চ্যালেঞ্জ মোতাবেক দু’পক্ষের ওলামায়ে কেরামগণ শুক্রবার এ বিতর্কে অংশ নেন।
এ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশ জমিয়তে আহলে হাদীসের সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল ওয়াহাব লাবীব। তার সঙ্গে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন ময়মনসিংহের কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব মাদানী ও জামালপুরের সরিষবাড়ি কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল নুরুল হুদা।
সৌদি আরবের সঙ্গে ঈদ করার পক্ষে বিতর্কে অংশ নেন আবুল কাশেম (কুড়িগ্রাম), জুলহাস উদ্দিন, রেজাউল হক, আনোয়ারুল হক ও জহিরুল ইসলাম। বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন ড.আব্দুল্লাহ ফারুক, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, কামরুজ্জামান, মুফতি মুনির উদ্দিন ও কামরুজ্জামান বিন আব্দুল বারী। বিতর্ক পরিচালনা করেন শহরের গুলপুকুরপাড় আহলে হাদিস জামে মসজিদের খতিব আব্দুল্লাহ আল মামুন।
সৌদি আরবের পক্ষে বক্তারা বলেন, চন্দ্রের মাসের ২৯টি মঞ্জিল থাকে। আল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যকে মধ্যস্থল করেছেন। এ কারণে সারা বিশ্বে মুসলমানদের একই দিনে সিয়াম-ঈদ পালন করতে হবে।
তারা বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন সিয়াম রাখ, যদি তোমরা দু’জনের সাক্ষ্য পাও। অসংখ্য মানুষের সাক্ষের ভিত্তিতে একই দিনে মুসলিম বিশ্বে সিয়াম-ঈদ করতে হবে। কারণ পৃথিবীতে চাঁদ একটি। পৃথিবীর সব তারিখও একটিই।
এসব যুক্তির বিপক্ষে চাঁদ দেখে বাংলাদেশে ঈদ করার পক্ষের আলেম-ওলামারা উল্টো প্রশ্ন রাখেন, আল্লাহতালা চাঁদের জন্য অনেক স্তর নির্ধারণ করেছেন। আমাদের দেশে চাঁদ আসেনি, তাহলে আমরা ঈদ করবো কীভাবে?
এসব ওলামায়ে-কেরাম বলেন, ১৪৬১ সালে সৌদি আরবে সারা বিশ্বের মাজহাবে ওলামায়ে কেরাম বসেছিলেন। ওই বৈঠকে একই দিনে চাঁদ দেখে রোজা করা বা ঈদ করা সম্ভব না বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।
তারা বলেন, দেশে সরকার আছে। কিন্তু যারা চাঁদ দেখে রোজা-ঈদ করার সরকারি নির্দেশনা পালন করে না তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো যাবে না।
চাঁদের ২৮টি মঞ্জিল আছে উল্লেখ করে দেশে চাঁদ দেখে ঈদ করার পক্ষের বক্তারা বলেন, যখন আমাদের দেশের শেষ মঞ্জিলে চাঁদ আসবে না তখন আরেক দেশের চাঁদ দেখে আমরা কীভাবে ঈদ করবো? আল্লাহর রাসুল বলেছেন, চাঁদ দেখে রোজা রাখ, চাঁদ দেখে রোজা শেষ করো।
গোটা পৃথিবীতে একদিনে চাঁদ দেখা যায় না এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দিয়ে এ পক্ষের বক্তারা বলেন, ২০১৩ সালে রমজানের চাঁদ প্রথম দিন আমেরিকা, দ্বিতীয় দিন মধ্যপ্রাচ্যে ও তৃতীয় দিন উপমহাদেশে দেখা গেছে।
আপনারা সৌদি আরবের সঙ্গে রোজা রাখেন আবার ইফতারি করেন এ দেশের সময়ে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, রাসুল আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন আমরা চাঁদ দেখে ঈদ করবো।
সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ-রোজা করতে হবে এর অনুকূলে হাদিস দেখানোর চ্যালেঞ্জ করেন বাংলাদেশের পক্ষের আহলে হাদীসের অনুসারী আলেম-ওলামারা। কিন্তু আহলে হাদীসের ওই পক্ষটি এ সংক্রান্ত কোন হাদিস উপস্থাপন করতে পারেননি।
বিতর্কের বিচারক কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব মাদানী বলেন, যদি সৌদি আরবের চাঁদ দেখেই ঈদ করতে হয় তাহলে দু’দিন পরেও কেন সূক্ষ্ণ চাঁদ দেখা যায়? ২ দিনের চাঁদের মতো কেন বড় চাঁদ দেখা যায় না?
এটা আল্লাহর সৃষ্টিগত বিধান, যে একদিন সৌদি আরবে চাঁদ উঠবে, আরেকদিন বাংলাদেশে উঠবে। সুতরাং, সৌদি আরবের সঙ্গে চাঁদ দেখে ঈদ এ দেশে সম্ভব নয়। যারা এ কাজটি করছেন তারা কোরআন-হাদিস ও সরকারি আদেশ লঙ্ঘন করছেন।
বিতর্ক অনুষ্ঠানের সভাপতি বাংলাদেশ জমিয়তে আহলে হাদীসের সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল ওয়াহাব লাবীব বলেন, আমার বয়স ৭৮ বছর। ৪/৫ বছর ধরে দেখছি কেউ কেউ সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ করছেন। এ ফেৎনা কেন শুরু হলো সেটাই আমার প্রশ্ন।
তিনি বলেন, সৌদি আরবের পক্ষের বিতার্কিকরা চাঁদ দেখে ঈদ করার পক্ষের বিতার্কিকদের ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জের কোনো উত্তরই দিতে পারেননি। অথচ দেশে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ঈদ করা বিতার্কিকদের যুক্তি-তর্ক শাণিত ও তথ্যভিত্তিক। সুতরাং, সৌদি আরবের সঙ্গে একইদিনে সিয়াম শুরু ও ঈদ উদযাপন সম্ভব নয়। অঙ্গীকার নামার পরেও কেউ এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হবে।