ভাষা-মতিনের চোখে আলো দেখছেন ইকবাল-নাসরিন
ভাষা সেনাপতি আবদুল মতিন নেই। কিন্তু তার দান করা চোখ ঠিকই দেখছে পৃথিবীর রং, রূপ ও সৌন্দর্য। তার দান করা কর্নিয়া দিয়ে অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন ইকবাল কবীর ও রেশমা নাসরিন। তার চোখে শিক্ষক ইকবাল আবারও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে বেড়াবেন আর রেশমা ছুটবেন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে। গত ৪ঠা অক্টোবর লাইফ সাপোর্ট দেয়ার আগে ভাষা-মতিন তার চোখ সন্ধানীকে দান করে যান। গত বুধবার মারা যাওয়ার পর কর্নিয়া সংগ্রহ করে সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে ওই দুই ব্যক্তির চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়। মো. ইকবাল কবীর ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার বাংলাবাজার চাঁদগাজী স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন। প্রায় দুই বছর আগে থেকে তিনি বাম চোখে কম দেখতে শুরু করেন। গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত তার চোখটির কর্নিয়া নষ্ট হয়ে যায়। এতে চিরদিনের মতো আলো হারায় চোখটি। আবদুল মতিন চোখটি দান করার পর ওই কর্নিয়াটি বৃহস্পতিবার দুপুরেই তার চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়। অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করার পর প্রথমে তিনি দেখতে না পেলেও এখন অল্প অল্প করে আলো দেখতে পাচ্ছেন। তবে ডাক্তার তাদের জানিয়েছেন, শিগগিরই তারা পুরোপুরি দেখতে পাবেন। আবেগ-আপ্লুত ইকবাল কবীর বলেন, আবদুল মতিনের কর্নিয়া তার চোখে আলো ফিরিয়ে এনেছে। তিনি আজীবন মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তার আত্মদানের ফলটা আমি ভোগ করতে পেরে নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছি। ১৫ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ইকবাল কবীর বলেন, তিনি নেই কিন্তু তার চোখ দিয়ে আমি দেখবো। তিনি যেমন মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, চেষ্টা করবো আমিও মানুষের জন্য কাজ করার। ভাষা-মতিন ও তার পরিবারের কল্যাণ কামনা করে তিনি বলেন, উনি একজন উদার মনের মানুষ, আল্লাহর কাছে তার জন্য এবং তার পবিবারের জন্য দোয়া করছি। অন্ধত্বের বেদনার কথা উল্লেখ করে ইকবাল আরও বলেন, অনেকে শুধু কর্নিয়া সমস্যার কারণে অন্ধত্ববরণ করেন। অসীম প্রতিভার অধিকারী হওয়ার পরও শুধু এ সমস্যার কারণেই তারা পিছিয়ে পড়েন, সবার কাছে বোঝা হয়ে যান। এ জন্য সবাইকে চক্ষুদানের মতো এ মহান উদ্যোগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালের তৃতীয় তলার পুরুষ ওয়ার্ডের ১নং কক্ষে চিকিৎসাধীন এ শিক্ষক আজ ভাষা সেনাপতির চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে এলাকায় যাবেন।
ভাষা সেনাপতির আরেক চোখ নিয়ে আলো দেখতে শুরু করেছেন ঢাকার ধামরাই উপজেলার শিয়ালপুর গ্রামের রেশমা নাসরিন। তিনি ওই উপজেলার সুয়াপুর ইউনিয়ন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রভাইডর (সিএইচসিপি)।
রেশমার বিয়ে হয়েছে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার ব্যবসায়ী আব্বাস আলীর সঙ্গে। তাদের ৭ বছরের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই রেশমার চোখ চুলকাতো। গত ২ বছর আগে থেকেই তিনি কম দেখতে শুরু করেন। দূরের জিনিস দেখতে পেতেন না। পড়াশোনাও করতে পারতেন না। একপর্যায়ে তার বাম চোখটি অন্ধ হয়ে যায়। তার পিতা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারেক মেয়ের চোখের আলো ফিরিয়ে আনতে অনেক জায়গায় চিকিৎসা করিয়েও কোন ফল পাননি। সমপ্রতি তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. মো. শীষ রহমানের শরণাপন্ন হন। তিনি পরামর্শ দেন নতুন কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করার। তার পরামর্শ মোতাবেক গত ২রা সেপ্টেম্বর সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে কর্নিয়া পেতে রেজিস্ট্রেশন করেন। বুধবার ভাষা-মতিন মারা যাওয়ার পর টেলিভিশনে তার চক্ষুদানের খবর পেয়ে রেশমা সন্ধানীতে ফোন করেন। এ সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে দ্রুত এসে ভর্তি হতে বলেন। বিনা খরচে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন এবং আবদুল মতিনের মতো একজন ব্যক্তির কর্নিয়া পেয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন রেশমা। তিনি বলেন, আমার অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তার পথ অনুসরণ করে নতুন প্রজন্মকেও এ কাজে উৎসাহিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি। রেশমার মা আবদুল মতিনের পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমাদের পরিবার কখনও আবদুল মতিনের এ দানের কথা ভুলবে না। তিনি বলেন, আজীবন তিনি যে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন মৃত্যুর পরও তার স্বাক্ষর রেখে গেলেন। হাসপাতালের ইনচার্জ ইলিয়াস হোসেন জানান, বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন আবদুল মতিনের অবস্থার অবনতি হলে লাইফ সাপোর্ট দেয়া পর তার ভাগ্নে সন্ধানীতে চক্ষুদানের কথা জানান। ওই সময় তিনি জানান, যে কোন সময় মামা মারা যেতে পারেন। বুধবার মারা গেলে দেড় ঘণ্টার মধ্যে তার কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয়। এ ব্যাপারে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ সালেক বলেন, মানুষ মানুষের জন্য, এটা উপলব্ধি করেই তার মতো একজন মহৎ ব্যক্তি চক্ষুদান করেছেন। ডা. সালেক ধর্মে চক্ষুদান বাধা নেই উল্লেখ করে বলেন, তার মতো যদি সবাই এ কাজে এগিয়ে আসতো তাহলে অনেক দৃষ্টিহীন মানুষ তাদের চোখের আলো ফিরে পেতো। এ ব্যাপারে সৌদি আরবের অনেক ধর্মীয় নেতা চক্ষুদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেকে না জেনে না বুঝে এর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, একসময় রক্তদানেও বাধা দেয়া হতো কিন্তু আজ সেটা অনেক সহজলভ্য হয়েছে। এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে তারা বিভিন্ন সময় সেমিনার করে থাকেন বলেও জানান। সবাইকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সন্ধানী সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চক্ষু প্রতিস্থাপন করে। ইকবাল কবীর ও রেশমার চোখে কর্নিয়ার সফল প্রতিস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষুবিশেষজ্ঞ কর্নিয়া সার্জন ডা. মো. শীষ রহমান। তিনি জানান, আপাতত অপারেশন সফল হয়েছে এটুকু আমরা বলতে পারি। সাধারণত কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ৬ মাস আগে সফল দাবি করা যায় না উল্লেখ তিনি বলেন, ১-২ সপ্তাহ পর অবস্থা কিছুটা বোঝা যাবে। ডা. শীষ রহমান আরও জানান, ওই দুই রোগী বাম চোখে মোটেই দেখতে পেতেন না। গতকাল থেকে কিছুটা দেখতে শুরু করেছেন। আশা করা যায়, তারা পুরোপুরি দেখতে পাবেন। তিনি আরও বলেন, সাধারণত বয়স্ক মানুষের কর্নিয়ার অবস্থা খুব ভাল থাকে না। কিন্তু আবদুল মতিনের কর্নিয়ার অবস্থা তুলনামূলক অনেক ভাল ছিল।
উল্লেখ্য, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮১০টি কর্নিয়া সংগ্রহ করেছে, যার ৩ হাজার ২৯৬ জনের চোখে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন। ২০০৬ সালে ভাষা সেনাপতি আবদুল মতিন সুস্থ থাকা অবস্থায় তার দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করার জন্য উইল করে যান। সে মোতাবেক বৃহস্পতিবার ওই কলেজের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য তার দেহ এনাটমি বিভাগে হস্তান্তর করা হয়।