কে এই পিয়াস করিম? প্রবাস আমিন
পিয়াস করিম আমাদের এলাকার লোক, মানে কুমিল্লার লোক। কিন্তু মৃত্যুর আগে তার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা ছিল না। মৃত্যুর পর একদিনে তার সম্পর্কে এত তথ্য পেয়েছি যে নিজেকে রীতিমত তথ্য ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছে। শুধু তার নয়, তার চৌদ্দগুষ্ঠির ঠিকুজি এখন ফেসবুকের পাতায় পাতায়। তার পিতা এম এ করিম একাত্তরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। পিতার অপরাধে আমি পুত্রকে দায়ী করতে চাই না। যদি পিতার অপরাধের দায় সন্তানকে নিতেই হবে, তাহলে একা পিয়াস করিমকেই নিতে হবে কেন? পিয়াস করিমের বোন তৌফিকা করিম তো আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হকের আইন ব্যবসার পার্টনার। সুপ্রিম কোর্টে তারা একই কক্ষে বসতেন। তৌফিকা করিমের স্বামী ব্যবসায়ী নেতা আফতাবউল ইসলাম মঞ্জু কুমিল্লা সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে কিছুদিন দৌড়ঝাঁপ করেছেন। আপনার পক্ষে বললেই আমি মুক্তিযোদ্ধা, বিপক্ষে বললেই রাজাকার- এটা কোনো ক্রাইটেরিয়া হতে পারে না। আমি পিতার কর্মফলে নয়, ব্যক্তিকে বিচার করতে চাই তার নিজের কর্ম দিয়ে। পিতা রাজাকার, ছেলে মুক্তিযোদ্ধা- এমন উদাহরণ তো বিরল নয়।
পিয়াস করিম আলোচিত-সমালোচিত তার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে। একজন শিক্ষক বিএনপিকে সমর্থন করতেই পারেন। বিএনপি সমর্থক আরো অনেক শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী আছেন। কিন্তু তারা কেউ পিয়াস করিমের মত আলোচিত নন। পিয়াস করিম গত বছর শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে দিনের পর দিন বক্তব্য দিয়েছেন। তার অবস্থান ছিল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। এখানেই তার মতের সাথে আমার প্রবল অমিল। কিন্তু আমি তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা জানাই। সকালে দিনের প্রথম স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম, মতের অমিল থাকলেও তাকে আমি পছন্দ করতাম। তার অকাল মৃত্যুতে আমার মন খুব খারাপ। সারাদিনই আমার মন খারাপ ছিল। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বহু মত, বহু পথ থাকবেই। সবাই যদি একই মতের হয়ে যায়, সে সমাজে তো আর বৈচিত্র থাকবে না। মতের অমিল থাকলেও বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়া পিয়াস করিমের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করা যেতো। উনি যুক্তি দিয়ে তার মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতেন। কখনো কখনো হয়তো সীমাও ছাড়িয়ে যেতেন। নিজের মত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। সে জন্যই তিনি এত সমালোচিত-আলোচিত। মুর্খ বন্ধুর চেয়ে জ্ঞানী শত্রুও ভালো। মৃত্যুর পর যেভাবে পিয়াস করিমের চরিত্রহনন করা হচ্ছে, যে ভাষায় তাকে গালিগালাজ করা হচ্ছে, তাতে আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেছি। ভিন্নমতের প্রতি এত অশ্রদ্ধা আমাদের ভেতরে, এটা বিস্ময়কর। পিয়াস করিমের অপরাধ কি? তিনি সুন্দর করে, হয়তো সত্যের সাথে মিথ্যা মিশিয়ে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির পক্ষে সাফাই গাইতেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আপনি তার পাল্টা যুক্তি দেন, গালি দেবেন কেন? গালি দেয়া মানে আপনার পক্ষে যুক্তি কম।
এখন প্রশ্ন হলো, পিয়াস করিমটা কে? বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। এমন অধ্যাপক বাংলাদেশে হাজার হাজার আছে। তাহলে তার স্বাভাবিক মৃত্যুতে গণমাধ্যমে এত কাভারেজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত হইচই কেন? পিয়াস করিম বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ‘টকমারানি’দের একজন। টিভি টকশোই তাকে তারকা বানিয়েছে। শুধু টক শো করে বিএনপি-জামাত ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের ছোট্ট সার্কেলে নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। এটা অবশ্যই তার কৃতিত্ব। কিন্তু গত কয়েকবছরের টিভি টক শো পারফরম্যান্স বাদ দিলে পিয়াস করিমের মৃত্যু পত্রিকার ভেতরের পাতার সিঙ্গেল কলাম নিউজ। ছাত্রজীবনে বামপন্থি রাজনীতির সাথে জড়িত পিয়াস করিম বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের তীব্র সমালোচক ছিলেন। সরকারের সমালোচনা করা অন্যায় নয়। কিন্তু পিয়াস করিম সবকিছুতে এমনভাবে সমালোচনা করতেন, তাতে তাকে বিএনপি-জামাতপন্থি ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়। শুরুর দিকে তিনি এতে আপত্তি করতেন। বলতেন, আমি তো বিএনপি-জামাতকে ডিফেন্ড করতে আসিনি। কিন্তু সবাই বলতে বলতে তিনি নিজেও একসময় সেই ট্যাগটিকেই নিজের সাইনবোর্ড বানিয়ে ফেলেন। পিয়াস করিম বলতেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে এবং খারাপ কাজ করলেও তিনি একই ভাষায় সমালোচনা করবেন। সেই সমালোচনা করার সুযোগ অবশ্য তিনি পেলেন না।
আগামী বুধবার পিয়াস করিমের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এমনটাই তার পরিবার-শুভাকাঙ্ক্ষীদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হবে কেন? তার কোন অবদানের জন্য? পিয়াস করিম যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকও হতেন, তাহলেও আমি এই প্রশ্ন করতাম। কয়েকবছর নিয়মিত টক শো’তে অংশগ্রহণ ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ে তার অবদান কতটুকু? শ্রদ্ধেয় লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যুর পর সবার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মরদেহ শহীদ মিনারে রাখার একটা চল আছে এবং এর কোনো নির্ধারিত মাপকাঠি বা বয়স নেই। কিন্তু তারপরও যে চল, তাতেও পিয়াস করিম মরদেহ শহীদ মিনারে রাখার মত মাপের বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। তারচেয়ে বড় কথা, তার শেষ সময়ের রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্য ভাষা আন্দোলনের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে। সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় তার মরদেহ বায়তুল মোকাররমে নিলে ঠিক হয়। তাছাড়া ইতোমধ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর পাল্টা বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আমি মনে করি, যারা পিয়াস করিমের মরদেহ শহীদ মিনারে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা তার শুভাকাঙ্খী নন। মৃত্যুর পরও তাকে নিয়ে রাজনৈতিক টানাটানি করাটা শোভন নয়। ব্যক্তিগত পছন্দের সুবাদে পিয়াস করিমের মৃত্যুতে দিনভর মন খারাপ থাকলেও আমি তার মরদেহ শহীদ মিনারে না নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি তার পরিবারের প্রতি। প্লিজ বেচারাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।