মার্চে মধ্যবর্তী নির্বাচন : বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের লক্ষ্য
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে মধ্যবর্তী নির্বাচন চায়। সে লক্ষ্যে বেগম খালেদা জিয়া জোট নেতাদের নিয়ে এবার আন্দোলনে নেমেছেন। জোট নেতারা বিএনপি চেয়ারপার্সনের নেতৃত্বে এ আন্দোলনকে দুটি ধারায় এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি একত্রে শেষ করা। দ্বিতীয়টি, নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করা।
আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য দল ও জোটকে প্রস্তুত করার কাজ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ইতোমধ্যে শুরু করেছেন। দলের বিভাগীয় পর্যায়ের সর্বস্তরের নেতাদের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে মতবিনিময় গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে শুরু করেছেন। ধারাবাহিকভাবে তিনি ঢাকা বিভাগ, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ও রংপুর বিভাগের নেতাদের সাথে মতবিনিময় শেষ করেছেন। এ পর্যায়ে আগামীকাল চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ২০ অক্টোবর রাজশাহী বিভাগের নেতাদের সাথে বেগম খালেদা জিয়া মতবিনিময় করবেন। দলীয় সূত্র মতে, বিএনপি চেয়ারপার্সন ঘরোয়া এ মতবিনিময়ের মাধ্যমে আন্দোলনের কৌশল এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়টি চূড়ান্ত করছেন। অন্যদিকে সর্বস্তরের জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে জোট নেতাদের নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া দেশব্যাপী সফর কর্মসূচিও গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে জোটনেত্রী মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী এবং জামালপুর জেলায় সমাবেশ করেছেন। দেশব্যাপী এই জনসংযোগ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী ২৩ অক্টোবর নিলফামারী এবং ৩০ অক্টোবর নাটোর জেলায় বেগম খালেদা জিয়া জোট নেতাদের নিয়ে সমাবেশ করবেন। এ ছাড়া আগামী ৬ নেভেম্বর কুমিল্লা এবং ১৫ নভেম্বর কিশোরগঞ্জেও সমাবেশের প্রস্তুতি চলছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এভাবে পুরো ডিসেম্বর মাস গণসংযোগের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের প্রাক প্রস্তুতি শেষ করে জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বৃহৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। জানুয়ারিতেই চূড়ান্ত আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা হবে এটাই ২০দলীয় জোটের চলতি আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য।
আন্দোলন জোরদার এবং সফল করতে জনগণের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি সাংগঠনিক শক্তি আরও সুদৃঢ় করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে বিএনপি। এরমধ্যে শ্রমিক দল ও ছাত্রদলের নতুন কমিটি করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। আন্দোলনের রূপরেখা এবং সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। মহানগর বিএনপির সব ওয়ার্ড ও থানায় দ্রুত কমিটি দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। এ ছাড়া যুবদলসহ অন্যান্য অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটিও খুব শিগগির ঘোষণা করা হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে ইনকিলাবকে বলেন, দেশে এখন কোনো গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি দেশে বিরাজমান। এ অবস্থায় দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে অতি দ্রুত একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রয়োজন। আমরা সে লক্ষ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করে সমাবেশ করছেন। এতে গণতন্ত্র রক্ষার এ আন্দোলন আজ জনগণের আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। আমরা মনে করি, জনতার আন্দোলনের মুখে এ সরকার অচিরেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।
জোটের শরিক দল জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান ইনকিলাবকে বলেন, আমরা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সংকট রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করছি। একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে অতিদ্রুত নির্বাচনের দাবি আজ এদেশের সকল গণতন্ত্রকামী মানুষের। সরকার যদি এ দাবি মেনে দিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে নির্বাচনের আয়োজন করে তাহলে তা হবে জাতির জন্য মঙ্গলজনক। আর আগামী মার্চের মধ্যে নির্বাচন না হলে, আমরা উপকৃত হব কি না জানিনা, তবে শেখ হাসিনার ক্ষমতার বাতি নিভে যাবে এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
আন্দোলনের পাশাপাশি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার বিষয়েও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট কাজ করে যাচ্ছে। গত ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচিত। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার সংগঠন গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করে। দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখতে তারা অতিদ্রুত সবদলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার জন্য সরকারকে বারবার নানাভাবে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলের এই চাপ যাতে আরও বৃদ্ধি পায় সে লক্ষ্যেও বিএনপি তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছে। বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দলীয় নেতাদের বাইরেও বিভিন্ন পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে পৃথক একটি টিম গঠন করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সনের কূটনৈতিক কোরকেও আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। এরমধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে এসেছে। বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিনিধি দল আমেরিকায় বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের বর্তমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন জরুরি এমন ইঙ্গিত আন্তর্জাতিক মহল থেকে বার বার দেয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি দাবি করছেন, ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- এবং দেশের স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অনেকে প্রশংসাও করছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান এ বিষয়ে ইনকিলাবকে বলেন, আন্তর্জাতিক পরিম-লে এ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার পক্ষে বিগত ৯ মাসে কি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে তা আমার জানা নেই। বরং এ প্রেক্ষিতে বিদেশের সমর্থন পাওয়ার দাবি করে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন বক্তব্যের বেশ কয়েকটির সংশোধনী বিদেশ থেকে এসেছে, যা আমাদের ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। দেশবাসী স্পষ্টতই জানে, ১০ নম্বর ডাউনিং স্টিট থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থন পাওয়ার দাবিকে নসাৎ করে দেয়া বক্তব্য এদেশের মিডিয়ায়ও প্রচার হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের অফিস থেকে স্পষ্টতই বাংলাদেশে গণতন্ত্র না থাকার বিষয়টি পরিষ্কার করে দুই অনুচ্ছেদের প্রেস রিলিজ নিউইয়র্ক থেকে তারা ইস্যু করতে বাধ্য হয়েছে। আর আমাদের জানা মতে ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার সম্পূর্ণ অবহিত যে গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়নি। আর এ প্রসঙ্গে বলার প্রয়োজন নেই যে, সর্বশেষ ইতালি সফরসহ যে কয়টি বিদেশ সফর হয়েছে তার একটিও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সফর নয়। সেগুলোকে এনজিও সফর বললেও অতিরিক্ত বলা হবে।