‘মহাদুর্নীতির’ অনুসন্ধানে আবারো চাঙ্গা দুদক!
দেশের প্রথম জাহাজ রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১৬০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ‘মহাদুর্নীতির’ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান কার্যক্রম আবারো চাঙ্গা হতে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র খবর বাংলা২৪.কম-কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা প্রিয়.কম-কে বলেন, আগামী সপ্তাহে নতুন একটি অনুসন্ধানকারী দল আনন্দ শিপ ইয়ার্ডের জালিয়াতি, অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামতে যাচ্ছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিলে দুদক কমিশন উপ-পরিচালক মীর জয়নাল আবেদীন শিবলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে আনন্দ শিপ ইয়ার্ডের অনিয়ম-দুর্নীতিটি আর্থিক দিক থেকে বেশি হওয়ায় এই অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা গত ২৮ আগষ্ট অনুসন্ধান কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি অনুসন্ধানকারী দল নিয়োগের জন্য কমিশনে চিঠি প্রেরণ করেন। সম্প্রতি কমিশনের বৈঠকে আনন্দ শিপ ইয়ার্ডের অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি অনুসন্ধানকারী টিম গঠনের অনুমোদন দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আনন্দ শিপইয়ার্ডের আর্থিক দুর্নীতির পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ (বকেয়া) হিসেবে ধরা পড়লেও তা বেশ বাড়বে। বর্তমানে এ ঋণ সুদ-আসলে বেশ বড় অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় আনন্দ শিপইয়ার্ডকে ঋণ দিয়ে বেশ বিপাকেই পড়েছে মোট ১৪ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এদিকে অর্থ আত্মসাত করে আনন্দ শিপইয়ার্ড বিদেশে অর্থপাচার করেছে কি না তা অনুসন্ধানে খতিয়ে দেখবে বলে জানিয়েছে দুদকের এই সূত্র।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জাহাজ রফতানির নামে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া জাহাজ নির্মাণের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই এই ঋণ পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এসব জালিয়াতির তথ্য উঠে আসে।
দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা প্রিয়.কম-কে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির এমডি আফরোজা বারীকে জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং আনন্দ শিপইয়ার্ড এ ধরনের কোনো ঘটনার সাথে জড়িত নয় বলেও দাবি করেন। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে জানান, জাহাজ রপ্তানীর চুক্তি বাতিল হওয়াতে তাদের বর্তমানে জাহাজগুলো পড়ে রয়েছে। যা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিলম্বের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে অনুসন্ধানের জন্য দুদক ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (কারওয়ানবাজার শাখা), এবি ব্যাংক লিমিটেড (কারওয়ানবাজার শাখা), মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড (ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট শাখা), ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড (মতিঝিল শাখা), জনতা ব্যাংক লিমিটেড (লোকাল অফিস), এনসিসি ব্যাংক লিমিটেড ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (প্রধান শাখা), ফিনিক্স ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (পিএফআইএল), বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিনান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসিএল), ফারইস্ট ফিনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (এফএফআইএল), আইডিএলসি ফাইনান্স, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (এনএইচএফয়াইএল), হজ ফিনান্স কোম্পানি লিমিটেড (এইচএফসিএল) ও প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিনান্স লিমিটেডের (পিএলএফেল) কাছে আনন্দ শিপইয়ার্ডের নেয়া ঋণের সকল কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন দেখা গেছে, আনন্দ শিপইয়ার্ডের সঙ্গে ব্যাংকিং সম্পর্ক স্থাপনের আগেই অনেক ব্যাংক ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রাহকের প্রস্তাবিত অংকের চেয়েও বেশি ঋণ ছাড় করা হয়েছে। আবার কিস্তি নবায়নেও কোনো ডাউন পেমেন্ট দেয়া হয়নি। অননুমোদিত ফান্ডেড দায় সুকৌশলে নন-ফান্ডেড হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে এবং ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র আড়াল করে ঋণ ঝুঁকি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এছাড়া আনন্দের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে ‘জেভি অব ইলিকট ড্রেজ এলএলসি অ্যান্ড আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড’ নামে বিদেশি যে প্রতিষ্ঠানের ৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে, তার স্বপক্ষে বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যৌথ অংশীদারি কোম্পানির নামে জাহাজ নির্মাণের অর্ডার হলেও বিধিবহির্ভূতভাবে এ নামে কোনো কার্যক্রম চালানো হয়নি। তাছাড়া অনুমোদিত ডিলার (এডি) শাখা না হওয়া সত্ত্বেও একটি ব্যাংক ওই শাখার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন চালিয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, জাহাজ রফতানির ব্যবসায় জালিয়াতির সাথে বিভিন্ন ব্যাংকেরও যোগসাজশ এবং অনিয়মও রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। তাদের কাছে আনন্দ শিপইয়ার্ডের মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমান ৪৫৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এবি ব্যাংক লিমিটেড (কারওয়ান বাজার শাখা)-ঢাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড (ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট শাখা- ঢাকা), ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড (মতিঝিল শাখা-ঢাকা), জনতা ব্যাংক লিমিটেড (লোকাল অফিস- ঢাকা), এনসিসি ব্যাংক লিমিটেড -ঢাকা, বাংলাদেশ ডেভোলেপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড -ঢাকা, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইনান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসিএল)-ঢাকা, ফিনিক্স ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (পিএফআইএল)-ঢাকা, ফারইস্ট ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (এফএফআইএল)-ঢাকা, আইডিএলসি ফাইনান্স-ঢাকা, ন্যাশানাল হাউজিং ফাইনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (এনএইচএফয়াইএল)-ঢাকা, হজ ফাইনান্স কোম্পানি লিমিটেড (এইচএফসিএল)-ঢাকা এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্স লিমিটেড (পিএলএফেল), ঢাকা।
এছাড়াও আনন্দ শিপইয়ার্ড ব্যাংকগুলোর অজ্ঞাতে পুঁজিবাজারে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ার ছেড়ে ১৪০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রতিষ্ঠানটির আইপিও ছাড়ার অনুমোদন দেয়নি, এতে প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের অর্থপ্রাপ্তিতেও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা গেছে, আনন্দ শিপইয়ার্ড আমেরিকার একটি কোম্পানির সঙ্গে ৯৫ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে যৌথ মালিকানায় একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি নিজেই আমদানিকারক সেজে জাহাজ রফতানির অর্ডার দিয়েছে। আবার সেই অর্ডার বাতিলও করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আনন্দ শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ ঋণের টাকা দিয়ে ময়মনসিংহের ভালুকায় কয়েক শ’ একর জমি ক্রয় করেছে। গাজীপুরের টঙ্গীতে বর্তমানে তার অত্যাধুনিক একটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে দুটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছে।
সূত্রমতে, ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান জাহাজ নির্মাণে প্রকল্প ঋণ, সিসি, এলটিআর, এলসি, গ্যারান্টি প্রদানের মাধ্যমে আনন্দ শিপইয়ার্ডের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থের ঋণ সৃষ্টি করেছিল। বর্তমানে ১ হাজার ২৯০ কোটি ৮৪ লাখ টাকার ঋণ অনাদায়ী রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি সময়মতো জাহাজ রফতানি করতে পারেনি, এ রকম নানা অজুহাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এসব ঋণ পরিশোধের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির আটটি চুক্তির বিপরীতে বিদেশ থেকে আসা অর্থের ব্যবহার যাচাই না করে গ্রাহককে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। যেসব চুক্তির বিপরীতে অর্থ এসেছিল, তা বাতিল হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোকে চুক্তি অনুযায়ী সুদসহ মুনাফা বিদেশি গ্রাহককে পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে যে পরিমাণ মুদ্রা দেশে এসেছিল, সুদসহ তার চেয়ে বেশি পরিমাণ মুদ্রা বিদেশে পাঠাতে হয়েছে।
সূত্রমতে, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের কাজে লাগিয়ে একাধিক সুবিধা নেয় প্রতিষ্ঠানটি। পূর্ণাঙ্গ জাহাজ নির্মাণের আগে আংশিক নির্মাণের ওপর রফতানিতে নগদ সহায়তার সুযোগ দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শর্ত হিসেবে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ছাড়পত্র নেয়ার বিধান রাখলেও তা পরিপালন করা হয়নি।
দুদকের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো ঝুঁকি বিবেচনায় না এনে একের পর এক আনন্দ শিপইয়ার্ডকে অর্থায়ন করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পর্যন্ত চারটি ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এতে স্বল্প জামানতে বিপুল পরিমাণ ঋণ প্রদানের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই ছাড়া এভাবে অর্থায়ন করা ব্যাংকিং নিয়মাচারের পরিপন্থী। এতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকারও অভিযোগ এসেছে।
এর আগে চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেশের প্রথম জাহাজ রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ডের জালিয়াতির মাধ্যমে ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১৬০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার তথ্য উঠে আসে। বিষয়টি দুদকের কাছে পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যা কমিশনে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গৃহিত হওয়ার পর দুদক সাতটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করে। ইতোমধ্যেই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে আনন্দ শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফরোজা বারীকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ বারী ফারিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা থাকলেও তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ওই দিন দুদকের কাছে ১৫ দিন সময় প্রার্থনা করেন। কিন্তু দূর্গাপূজা-ঈদের ছুটি থাকায় এখনো তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। তবে খুব শিগগিরই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে বলে প্রিয়.কম-কে নিশ্চিত করেছে দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্র।
প্রসঙ্গত, জাহাজ রপ্তানিতে অবদানের জন্য আনন্দ শিপইয়ার্ড ২০০৯ সালে ‘জাতীয় রপ্তানি স্বর্ণ পদক’ পায়। সেসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠানটির কর্তা ব্যক্তিদের হাতে পদক তুলে দেন।