সিলেটে ধর্মঘট ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত ; দুই ঘণ্টার তাণ্ডবে ক্ষতি ২ কোটি টাকা
নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় সিলেটের পরিবহন সেক্টরে আতঙ্ক নেমে এসেছে। বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। পরিবহন শ্রমিকদের বিভক্তির কারণে এক পক্ষ আরেক পক্ষের গাড়ি ভাঙচুর করছে। শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত থেমে থেমে চলে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা। পরিবহন শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, দুই ঘণ্টার তাণ্ডবে সিলেটে পরিবহন সেক্টরে দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঘটনার পর এ তাণ্ডবের দায়ভার নিচ্ছে না কেউ। ফলে মালিকরা আতঙ্কে গাড়ি রাস্তায় নামাচ্ছেন না। অন্যদিকে গতকাল সকাল থেকে সিলেটে শুরু হওয়া অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে সিলেট। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় রাজধানী ঢাকা সহ গোটা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সিলেট। পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত থাকায় সিলেটে যাত্রী দুর্ভোগও চরম আকার ধারণ করেছে। সিলেট থেকে ঢাকাগামী বাস সার্ভিসগুলোর অগ্রিম টিকিট ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে যাত্রীদের। পরিবহন ধর্মঘট চলাকালে সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় লাঠি মিছিল করেছেন। ওদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল বিকেলে ধর্মঘট করা পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক। রাতে বৈঠকের প্রেক্ষিতে ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। সিলেটের পরিবহন সেক্টরে বিভক্তি নতুন নয়। তবে চলমান সঙ্কটের সৃষ্টি বেশি দিন আগেও নয়। মূলত যাত্রী ওঠানামাকে কেন্দ্র করে সিলেটের বাস পরিবহন ইউনিয়ন ও সিএনজি অটোরিকশা পরিবহন ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পরিবহন শ্রমিকরা জানান, সিলেটের নগরীর সঙ্গে সংযোগ বিভিন্ন উপজেলার সঙ্গে বাস সার্ভিসের পাশাপাশি সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করে। গত কয়েক বছর ধরে যাত্রী ওঠানামাকে কেন্দ্র করে বাস শ্রমিকদের সঙ্গে সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকদের বিরোধ চলছে। এ বিরোধের কারণে কয়েক মাস আগে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিভক্তি। চলতি মাসের প্রথম দিকে উভয় সংগঠনের পক্ষ থেকে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সিএনজি অটোরিকশা সংগঠনের নেতারা নিজেদের শক্তি জানান দিতে ৭ দফা দাবি তুলে ধরে শনিবার রেজিস্টারি মাঠে মহাসমাবেশ করে। আর ৫ দফা দাবি উপস্থাপন করে গতকাল রোববার সিলেটে একদিনের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন। পরিবহন শ্রমিকরা জানান, দুই সংগঠনের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই বিরাজ করার মুহূর্তে শনিবার মহাসমাবেশে আসার পথে হঠাৎ করে একদল সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। তাদের ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডবে সিলেটে বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক সহ শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করা হয় বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক। তিনি বলেন, নির্বিচারে ভাঙচুরের ফলে প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাকারিয়া আহমদ জানিয়েছেন, বাস পরিবহন শ্রমিকরা তাদের ২০-২৫টি সিএনজি অটোরিকশা ভাঙচুরের পাশাপাশি বেশ কয়েকটিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এতে করে তাদের সংগঠনের নেতাদের কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া পুলিশ শ্রমিকদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে কয়েকজন শ্রমিককে আহত করেছে। উভয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলাপ জানা গেছে, মাত্র দুই ঘণ্টার তাণ্ডবে সিলেটে বিবদমান দু’দল শ্রমিকের দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর তাণ্ডব-পাল্টা তাণ্ডবের পর পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নগরীর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হলেও গুটিকয়েক যানবাহন ছাড়াও গণপরিবহন চলাচল করেনি। সিলেট জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে মাইক্রোবাস, মিনিবাস, ট্রাক সহ বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের নেতারা একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় গাড়ি নামাননি। তবে সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা জানিয়েছেন, তারা রাস্তায় গাড়ি বের করেছেন। গাড়ি চলেছেও। তবে বাস্তবে রাস্তায় চলাচলকারী সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা ছিল খুবই কম।
ধর্মঘটে অচল সিলেট: শনিবারের তাণ্ডবের পর আকস্মিক সিলেট থেকে সব রুটে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল ওই ধর্মঘট লাগাতার চলবে। কিন্তু রাতে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল ৬টা পর্যন্ত ধর্মঘট শিথিল করা হয়েছিল। ভোর ৫টা থেকে পুনরায় শুরু করা হয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। এ কারণে সকাল থেকে ফাঁকা ছিল সিলেটের রাজপথ। দূরপাল্লার কোন যানবাহন সিলেট থেকে ছেড়ে যায়নি কিংবা প্রবেশ করেনি। সকাল ৬টা কদমতলীস্থ গ্রিনলাইন, শ্যামলী, ইউনিক, হানিফ সহ বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিসের কাউন্টার ছিল তালাবদ্ধ। ভাঙচুরের আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয় দূরপাল্লার যানবাহন। পরিবহন শ্রমিকরা জানান, শুধু বাস কিংবা মিনিবাস শ্রমিকদের ধর্মঘটে ট্রাক সহ পণ্যবাহী যানবাহনেও ধর্মঘট পালন করা হচ্ছে। এ কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পণ্যবাহী যানবাহন সিলেটে ঢোকেনি। পাশাপাশি জরুরি সার্ভিসের যানবাহনের চলাচল ছিল বন্ধ। ধর্মঘটের শুরু থেকে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা সিলেট নগরীর প্রবেশপথ হুমায়ুন রশীদ চত্বর, চণ্ডিপুল সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অবস্থান নেন। শ্রমিক নেতারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেও কোন ধরনের ভাঙচুর চালাননি। তবে সকাল ১০টার দিকে পরিবহন শ্রমিকদের একটি অংশ দক্ষিণ সুরমায় এলাকায় ধর্মঘটের সমর্থনে লাঠি মিছিল বের করে। বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তেরা মিয়া, শ্রমিক নেতা মাখন মিয়ার নেতৃত্বে মিছিলটি কীন ব্রিজ এলাকা ঘুরে কদমতলীতে অবস্থান নেয়। এ সময় দক্ষিণ সুরমা এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল।
একদিনে ক্ষতি ১২ কোটি টাকা: সিলেটে ধর্মঘটে পরিবহন সেক্টরে একদিনে ক্ষতি হয় ১২ কোটি টাকা। যদি ধর্মঘট লাগাতার থাকে তাহলে ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। পরিবহন শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, এবারের ধর্মঘটে কেবলমাত্র হালকা যান সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশা ছাড়া সব শ্রমিক সংগঠনের নেতারা একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এ কারণে এবার ক্ষতির পরিমাণ বেশি। তারা জানান, গাড়ি ভাঙচুরের প্রতিবাদস্বরূপ বিচার দাবিতে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। বিচার না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। এদিকে সিলেটের পরিবহন ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর প্রশাসন শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক গতকাল বিকাল ৪টা থেকে তার কার্যালয়ে বৈঠক শুরু করেছেন। বৈঠকে উপস্থিত সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক মনির মিয়া জানিয়েছেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈঠকের আলোচনার প্রেক্ষিতে কোন সুরাহা হয়নি। এ বৈঠকে সিলেটে রাজনৈতিক দলের নেতারা রয়েছেন বলে জানান তিনি।
ওসি মুরসালিনসহ পুলিশ সদস্যদের অপসারণ দাবি: বিনা উস্কানিতে নিরীহ পরিবহন শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণকারী দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি মো. মুরসালিনসহ দোষী পুলিশ সদস্যদের অপসারণ ও সুষ্ঠু বিচার, নিরীহ বাস-মিনিবাস এবং ট্রাক শ্রমিকদের ওপর হামলাকারী শ্রমিক নামধারী কিছু দালাল ও গুণ্ডাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ও সংগ্রাম কমিটি। বিনা কারণে রাতে কদমতলীস্থ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পরিবহন শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ, অমানবিক জুলুম-নির্যাতন, মহাসমাবেশে যোগদানের নামে কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে নিরীহ বাস-মিনিবাস ও ট্রাক শ্রমিকদের ওপর হামলা করে ৬৫ জন শ্রমিককে আহত করা, শতাধিক বাস ও ৪০টি ট্রাক ভাঙচুরসহ শ্রমিক নামধারী গুণ্ডাদের নৈরাজ্য ও অপকর্মের প্রতিবাদে টার্মিনাল রোডস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত জরুরি বর্ধিত সভার প্রস্তাবে এ দাবি জানানো হয়। সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আলহাজ জমির আহমদের সভাপতিত্বে এবং সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রকিব উদ্দিন রফিকের পরিচালনায় সভার শুরুতে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদ বক্তব্য রাখেন কমিটির যুগ্ম আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম আহমদ ফলিক। পরিস্থিতির আলোকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন সংগ্রাম কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা পরিবহন মালিক নেতা আলহাজ নুরুল ইসলাম ফলিক, অন্যতম সদস্য নাজিম উদ্দিন লস্কর, আবদুল মান্নান, তেরা মিয়া, হেলাল উদ্দিন, শাহনুর রহমান, আবদুল কাদির, হিরণ মিয়া, শাহ মো. জিয়াউল কবির, শামসুল হক মানিক, আবুল কাশেম, মঈনুল হক, হাজী আহাদ আলী, আমিনুজ্জামান জাহাঙ্গীর, মুক্তার আহমদ এবং বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিলেট ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি আবদুস সালাম ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর। এছাড়া সভায় আরও প্রায় ৩ শতাধিক পরিবহন মালিক-শ্রমিক অংশ নেন।
৫ নভেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘট স্থগিত: সিলেটের অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছে আন্দোলনকারী সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। গতকাল সন্ধ্যায় পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠকের পর ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত থাকা সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক মনির মিয়া মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তিন ঘণ্টা আলোচনার পর তাণ্ডবে অংশ নেয়া সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস প্রদান করায় ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। বৈঠকে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলামসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানান তিনি। এছাড়া বৈঠকে সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক, সাধারণ সম্পাদক রাকিব উদ্দিন রকিব উপস্থিত ছিলেন।