আরো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী সরকারী কর্মকর্তার অনুসন্ধানে দুদক
সরকারী একাধিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির অভিযোগ উঠছে। এসব অভিযোগের ওপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানও করছে। এখন চলছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান বিরুদ্ধে অনুসন্ধান। এছাড়া সোমবার সচিবসহ আরো আট সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যাচাই-বাছাই শুরু করেছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী এই সংস্থা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জানান, এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানকে ২১ অক্টোবর দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছে। তবে তিনি একনেক বৈঠক থাকায় এদিন উপস্থিত হতে পারবেন না বলে দুদকে চিঠি দিয়েছেন। তাই তারিখ পুনঃনির্ধারন করে কমিশন তাকে আগামী ২৩ অক্টোবর হাজির হতে বলেছে।
জানা গেছে, ওয়াহিদুর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশকারী মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এস এম মতুর্জা হোসেন এবং সদস্য মাহবুবুল হক চিশতিকেও আগামী ২৩ অক্টোবর দুদকে হাজির হতে বলা হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী আগামী ২৩ অক্টোবর সকাল ১০টায় তাদের জিজ্ঞাসাদের জন্য হাজির হতে নোটিশ পাঠিয়েছেন।
দুদকের কাছে অভিযোগে বলা রয়েছে, ওয়াহিদুর রহমান চাকরিতে যোগ দেয়ার সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি। তবে চাকরির শেষ সময় মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণ করেন। এদিকে মুক্তিবার্তার লাল বইয়ে তার নামও নেই। তিনি কোন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং কোন সেক্টরে কার অধীনে যুদ্ধ করেছেন, এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য-প্রমাণও নেই। অভিযোগ উঠেছে, তিনি মূলত জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়েছেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, অনুসন্ধানের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান থেকে ইতোমধ্যেই নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। অনুসন্ধানের শেষ পর্যায়ে ওয়াহিদুর রহমান এবং তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুপারিশকারী দুই মুক্তিযোদ্ধাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিতর্ক উঠলেও এসুবিধা নিয়ে এর আগে তার চাকরির মেয়াদ দুই বছর বেড়েছিল। এরপর চাকরির বয়স সরকারিভাবে এক বছর বাড়ানো হলে সেই সুবিধাও পান তিনি। নিয়মিত চাকরির বাইরে তিন বছর পেলেও তিনি এলজিইডির রেওয়াজ ভঙ্গ করে এই প্রথম এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নেন। নিয়ম অনুযায়ী, আগামী ১৩ ডিসেম্বর তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
এলজিইডি সূত্র জানায়, প্রকোশলী ওয়াহিদুর রহমানের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পেছনে বড় ধরণের দুর্নীতি রয়েছে। কারণ তিনি প্রয়োজনীয় টাকার দ্বিগুণ বেশি টাকার প্রাক্কলন তৈরি করে থাকেন, যাতে সহজেই অর্থ লোপাট করা যায়। আর এতে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে প্রধান প্রকোশলীর বিরুদ্ধে। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ঘুষ দিয়ে ওয়াহেদুর রহমান ঠিকাদারী ব্যবসা করেন বলেও নানা মহলের অভিযোগ আছে।
সূত্রে জানা গেছে, ওয়াহিদুর রহমান ১৯৭৮ সাল থেকে সরকারি চাকরিতে রয়েছেন। জোট সরকারের আমলে তৎকালীন এক মন্ত্রীকে ম্যানেজ করে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জোগাড় করেন তিনি। এমনকি বর্তমান সরকারের সময়ে অর্থের বিনিময়ে এক প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও তার নিজ এলাকা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার পক্ষ থেকে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক কমান্ডার গোলাম মহিউদ্দিন পিন্টু ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার যুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার ইউনুছ আলী প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রেরিত এক স্মারক লিপিতে জানিয়েছিলেন, ওয়াহিদুর রহমান একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।
সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ দু’বছর বৃদ্ধি করায় সুকৌশলে এই সুবিধা নিয়েছেন ওয়াহিদুর রহমান।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ দাখিল করে চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির অভিযোগে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হেমায়েত হোসেনের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করছে দুদক।
এছাড়া সোমবার আরো পাঁচ সচিব, দুই যুগ্ম সচিব ও এক অতিরিক্ত সচিবসহ মোট আটজন সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার অভিযোগে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা শুরু করছে দুদক। সোমবার দুদক কমিশনে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া সরকারি কর্মকর্তারা হলেন- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব কাজী আখতার হোসেন, ধর্ম সচিব চৌধুরী মো. বাবুল হাসান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত সচিব মো. শাহাবউল্লাহ, বিসিএস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর শফিক আলম মেহেদী, ট্যারিফ কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, ওএসডি যুগ্ম সচিব জাকির হোসেন, ওএসডি যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এবং ওএসডি অতিরিক্ত সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন।
সূত্রে জানা গেছে, যেসব সরকারি কর্মকর্তা যখনই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন, তারাই মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ফিরোজ কিবরিয়া, উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত, মিজানুর রহমান ও কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী। এই সচিবদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই অসত্য তথ্য দিয়ে সনদ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, সরকারি এসব কর্মকর্তাদের কেউই চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি। এমনকি চাকরির প্রায় ৩০ বছরেও তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নেননি। চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর ঘোষণার পরই তারা এই সনদ নিয়েছেন। নিজেদের নামে সনদ নেওয়ার পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন এই সরকারি কর্মকর্তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে বাবা, ভাইসহ আত্মীয়-স্বজনের নামে সনদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আত্মীয়-স্বজনকে মুক্তিযোদ্ধা করার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মিজানুর রহমান। সম্প্রতি তিন সচিব ও এক যুগ্ম সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হওয়ার পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে।