ছাত্রদলেই নাকাল বিএনপি
দল পুনর্গঠন করে চলতি অক্টোবর মাসের শেষ বা নভেম্বরের শুরুর দিকে আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। আন্দোলনের প্রাথমিক ছক কষেছিেলন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু নতুন কমিটি ঘোষণার পরপর ছাত্রদলে ‘বিদ্রোহ’ বিপাকে ফেলেছে বিএনপিকে।
দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা প্রথম আলোকে জানান, ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পর গত ছয় দিনে পদবঞ্চিতদের বিদ্রোহ বিএনপির জন্য চরম ‘অস্বস্তিকর’ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামা তো দূরের কথা, ঘর সামলাতেই দেন-দরবারে বসতে হচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে। ছাত্রদল নিয়ে হঠাৎ সৃষ্ট এমন ঘটনায় দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বড় একটা অংশ খুব বিরক্ত। কিন্তু খালেদা জিয়া নিজে ছাত্রদলের কমিটি অনুমোদন দেওয়ায় বিএনপির অন্য নেতারা এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না।
১৪ অক্টোবর রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণার পর থেকেই পদবঞ্চিতদের একটি অংশ বিক্ষোভ শুরু করে। পঞ্চম দিন রোববার এ অংশটি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও স্বদলীয় প্রতিপক্ষকে মারধরও করেছে।
দলের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করছে, ছাত্রদলের এই ‘ধাক্কা’ বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে আরও অগোছালো অবস্থায় নিয়ে গেছে। এর ফলে আন্দোলনে নামতে ভেতরে ভেতরে বিএনপির মধ্যে যা কিছু তৎপরতা ছিল, তা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে।
এ ছাড়া ছাত্রদলের পরপরই যুবদলসহ আরও কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনেরও পরিকল্পনা ছিল বিএনপির চেয়ারপারসনের। এর মধ্যে যুবদলের কমিটি ঘোষণা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। ছাত্রদলের পরিস্থিতির কারণে যুবদলের কমিটি ঘোষণা পেছাতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পরও মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন-নবী খানের মধ্যে বিভক্তির প্রকাশ ঘটেছিল। তখনো এর মীমাংসা করতে দলীয় প্রধানকে বৈঠকে বসতে হয়েছিল একাধিকবার। ছাত্রদলের বিদ্রোহ নিরসনেও এখন খালেদা জিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ছাত্রদলের এই সংকটকে ‘অপ্রত্যাশিত’ হলেও ‘স্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সব বড় দলেই যাঁরা নিজেদের যোগ্য মনে করেন এবং তাঁদের একটা সমর্থকগোষ্ঠী থাকে, তাঁরা বঞ্চিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে একধরনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা দলের প্রতি আন্তরিক হলে পরবর্তীকালে এসব ঘটনা আন্দোলনে খুব ক্ষতি করবে না।
ছাত্রদলের বিদ্রোহীদের অভিযোগ, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন নিজেদের পছন্দে পকেট কমিটি করে এ-সংকটের জন্ম দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতান সালাউদ্দিন দাবি করেন, এটা ‘সরকারের ষড়যন্ত্র’। তিনি বলেন, বিরোধী দল যাতে সংগঠিত হতে না পারে, সে জন্য দল পুনর্গঠন করাসহ সব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।
৫ জানুয়ারির আগে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ ছিল। পদবঞ্চিতদের ‘সহিংস’ তৎপরতার মধ্যে গত কয়েক দিনে বিএনপির ভেতরে এমন আলোচনা হচ্ছে যে বিগত আন্দোলনের এই ছাত্রদল কোথায় ছিল।
ছাত্রদল নিয়ে বিএনপির নেতাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব: ছাত্রদল ও বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, ছাত্রদলের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে বিএনপির রাজনীতিতে নেতাদের প্রভাব বাড়ে, যে কারণে বিএনপির অনেক নেতা ছাত্রদল নিয়ে সক্রিয় থাকেন। এবার ছাত্রদলের কমিটিতে স্থান না পাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিএনপির ওই সব নেতার স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এর প্রভাব পড়ছে বিএনপির কেন্দ্র থেকে মহানগর কমিটি পর্যন্ত। যুবদলও এর বাইরে নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রদলের রাজনীতি নিয়ে বিএনপিতে অন্তত পাঁচটি পক্ষ সক্রিয়। কিন্তু এবারের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সবচেয়ে বেশি পদে ঠাঁই পেয়েছেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সুলতান সালাউদ্দিনের অনুসারীরা। এ ছাড়া ‘নিখোঁজ’ ইলিয়াস আলীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত অংশের নেতারাও কিছু পদ পেয়েছেন। এখন এ অংশটির পৃষ্ঠপোষকতা দেন ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান।
এর বাইরে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ এবং ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বর্তমানে কারাবন্দী নাসির উদ্দীন আহম্মেদের (পিন্টু) অনুসারী হিসেবে পরিচিত দুটি পক্ষ ছাত্রদলে সক্রিয় আছেন। এই দুটি পক্ষের অল্প কজন নতুন কমিটিতে ঠাঁই পেলেও, প্রত্যাশিত পদ পাননি। এ কারণে পদ পাওয়া এসব নেতারাও পদবঞ্চিতদের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন।
এখন বিক্ষোভে যাঁরা আছেন, তাঁদের বড় অংশ কারাবন্দী পিন্টুর অনুসারী। এই অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার।
এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের অনুসারীদের চেষ্টা ছিল এখনই পূর্ণাঙ্গ কমিটি না দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা। যাতে এই অংশের কাউকে আহ্বায়ক পদে বসানো যায়। এই চেষ্টা সফল হয়নি। এমনকি নতুন কমিটিতে এ অংশের কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদ পাননি। এখন ছাত্রদলের বিদ্রোহ সামাল দিতে এসব পক্ষগুলোকে নিষ্ক্রিয় রাখার চেষ্টা করছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
দলের একাধিক সূত্র জানায়, ছাত্রদলের নবনির্বাচিত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সুলতান সালাউদ্দিন। এই দুজনের বাইরে বিএনপির দুজন যুগ্ম মহাসচিব আড়ালে থেকে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁদের একজন বিএনপির মহাসচিব পদ পেতে আগ্রহী। শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সুলতান সালাউদ্দিন চান যুবদলের শীর্ষ নেতৃত্বে আসতে।
আবার পিন্টুও চান যুবদলের পরবর্তী কমিটির শীর্ষ দুটি পদের একটি থাকতে। পিন্টুর প্রতি মির্জা আব্বাসের আশীর্বাদ রয়েছে বলেও দলে আলোচনা আছে।
ছাত্রদলের যে অংশটি বিক্ষোভ করছে, তারা ছাত্রদলের নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের চেয়ে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সুলতান সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধেই বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। এই দুজনকে ছাত্রদল দেখভালের দায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করার দাবিও তুলেছেন তাঁরা।
তবে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, যুবদলের নেতৃত্বে যাওয়ার আগ্রহ তিনি কখনো প্রকাশ করেননি। তিনি যুবদলে পদ পেতেও চান না।
পদবঞ্চিতদের ক্ষোভের বিষয়ে শহীদ উদ্দীন বলেন, তিনি যেহেতু বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন, তাই এ দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না।
আর, সুলতান সালাউদ্দিন দাবি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।
আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বেই বিএনপি হোঁচট খেয়েছে। আর এ জন্য সরকারের কিছু করতে হয়নি, নিজেদের ছাত্রসংগঠনই এই পরিস্থিতির তৈরি করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে কয়েক দিন ধরে এমন আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রদলের কমিটি দিলে প্রতিবারই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। কারণ, দলে এত বেশি নেতা যে, সবাইকে পদ দেওয়া যায় না। তাঁর দাবি, ‘এ ঘটনা আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। ইতিমধ্যেই আমরা পরবর্তী কর্মসূচি দিয়েছি।’
‘বিদ্রোহ’ থামাতে তৎপরতা: বিনপির একাধিক সূত্র জানায়, ছাত্রদলের ‘বিদ্রোহ’ থামাতে গতকাল রাতে ও আগের রাতে মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, হাবিব-উন-নবী খান, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, সুলতান সালাউদ্দিন ও সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির চেয়াপারসন খালেদা জিয়া। তিনি পদবঞ্চিতদের যাঁদের বয়স ও যোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়ার মতো, তাঁদের ছাত্রদলে এবং বাকিদের অন্য সহযোগী সংগঠনের উপযুক্ত পদে সমন্বয় করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, রোববার পদবঞ্চিতদের বিক্ষোভের সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জিয়াউর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুরের বিষয়টি দলীয় প্রধানের কাছে বড় করে তুলে ধরতে তৎপর রয়েছেন দলের একটি অংশ। তাঁরা বোঝাতে চাইছেন, বিদ্রোহীরা সরকারের এজেন্ট।
এর আগে গতকাল দুপুরে বিদ্রোহী অংশের নেতা ও বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার মির্জা আব্বাসের বাসায় গিয়ে কথা বলেছেন।
মির্জা ফখরুল গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রদলের বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তে আসেননি। বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে তাঁরা আবারও কথা বলবেন।
এদিকে পদবঞ্চিতরা দুটি শর্তে গত রাত পর্যন্ত নতুন কোনো কর্মসূচিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর একটি হচ্ছে, ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কেন্দ্রীয় দপ্তরে না যাওয়া এবং শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও সুলতান সালাউদ্দিনকে ছাত্রদলের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা।
পদবঞ্চিত অংশের নেতাদের অন্যতম তরিকুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, নতুন কমিটির ১৭ জন বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদকের অধীনে রাজনীতি করতে চান না। এ জন্য তাঁরা অব্যাহতি চেয়েছেন।