মোবাইলে ব্যাংকিং: প্রতিদিন ২৫০ কোটি টাকার লেনদেন
ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এনেছে মোবাইল ব্যাংকিং। এখন প্রতিদিন গড়ে ২৫০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
কেবল টাকা পাঠানোই নয়, দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছে মোবাইল ব্যাংকিং। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন অন্যতম পছন্দের মাধ্যম। এই সেবার কারণে বেড়েছে নতুন কর্মসংস্থান।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দি ইকোনমিস্ট গত ২০-২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় শীর্ষ দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রথম অবস্থানে আছে কেনিয়া, তারপর তানজানিয়া, বোতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, ক্যামেরুন, ফিলিপিন্স। এর পরের অবস্থানই বাংলাদেশের। বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যত টাকা লেনদেন হয়, তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
কয়েকটি পদ্ধতিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ আনা-নেওয়া করা যায়। তার মধ্যে এজেন্টের কাছে গিয়ে সুনির্দিষ্ট মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠানো, এজেন্টের কাছে গিয়ে হিসাব খুলে সেখানে টাকা জমা করে নিজের মোবাইলে স্থিতি বা ব্যালান্স নিয়ে কাউকে পাঠানো এবং ব্যাংকে হিসাব খুলে সেখানে টাকা রেখে নিজের মোবাইলে স্থিতি নিয়ে লেনদেন সবচেয়ে জনপ্রিয়।
তবে এজেন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠানোতে ঝুঁকি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও মোবাইলপ্রযুক্তি সেবা প্রদান প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ হচ্ছে, প্রেরক ও প্রাপক উভয়েরই হিসাব খুলে অর্থ প্রেরণ নিরাপদ। প্রযুক্তি সেবা প্রদানকারীদের তথ্য অনুসারে, এখনো অনেক মানুষ এজেন্টের মাধ্যমেই টাকা পাঠান। তবে এজেন্টের কাছে গিয়ে নিজের হিসাব খুলে টাকা পাঠানোর পরিমাণ এখন বেড়ে ৬০ ভাগে উন্নীত হয়েছে।
কম খরচ ও দ্রুত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টাকা পাঠাতে প্রতিদিনই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য হিসাব খুলছেন বিপুলসংখ্যক গ্রাহক। প্রতি মাসেই বাড়ছে গ্রাহকসংখ্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাস পর্যন্ত এক কোটি ৯২ লাখ ৯১টি হিসাব খোলা হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২৮টি ব্যাংককে মোবাইল ব্যাংকিং করার অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর বর্তমানে ১৯টি ব্যাংকে এ সেবা চালু হয়েছে। গত আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৯৫ হাজার ৩৩৮টি। আগস্ট মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট সাত হাজার ৪৩৪ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। আগের মাস অর্থাৎ জুলাইয়ে লেনদেন বেশি হয়েছিল। ওই মাসে ১০ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৩৬৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। আর আগস্টে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৪৮ কোটি টাকা। জুলাই মাসজুড়ে রোজা থাকায় ওই সময়ে লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সিংহভাগ অর্থাৎ ৭০ শতাংশেরও বেশি লেনদেন হচ্ছে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশের মাধ্যমে।
যোগাযোগ করা হলে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার করেছে এ মোবাইল ব্যাংকিং। আগে যেখানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা পাঠাতে কয়েক দিন লাগত, সেখানে মাত্র কয়েক মিনিটে টাকা পৌঁছে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
কিছু ক্ষেত্রে এজেন্ট-কেন্দ্র বন্ধ থাকা এবং অপব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে কামাল কাদির বলেন, কিছু অপব্যবহারের অভিযোগ আছে, তবে সেটা কমে আসছে। এ ক্ষেত্রে যার কাছে টাকা পাঠানো হবে এবং যিনি টাকা পাঠাবেন, উভয়েরই যদি নিজের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব থাকে, তাহলে সেই হিসাবগুলোতে টাকা আনা-নেওয়া করলে অন্য কেউ অপব্যবহার করতে পারবে না।
২০০৮ সালের শেষদিকে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন প্রযুক্তির ব্যবহার করে ব্যাংকিংয়ের সেবা প্রবর্তন করা হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নীতিনির্ধারণে অবদান রাখায় বাংলাদেশ ব্যাংক ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সংগঠন এএফআইয়ের কাছ থেকে ‘অ্যালায়েন্স ফর ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন (এএফআই) পলিসি’ পুরস্কারও পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, বিশ্বে মুঠোফোনের ব্যবহার যত বাড়ছে ততই বাড়ছে এর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ। ব্যাংক হিসাব নেই এমন অনেক মানুষ এই সেবার মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করতে পারছেন। কঙ্গো, জিম্বাবুয়েসহ বিশ্বের আটটি দেশে মুঠোফোন হিসাবের সংখ্যা সাধারণ ব্যাংক হিসাবের সংখ্যার চেয়ে বেশি।
জিডিপির ৫.৬% লেনদেন
সেবা দিচ্ছে ১৯টি ব্যাংক
আগস্ট মাস পর্যন্ত এক কোটি ৯২ লাখ ৯১টি হিসাব চালু