ইবোলার ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

ebola_2

ঘটনা-১
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়া। সেখানকার পরিবহনমন্ত্রী এঞ্জেলা বুশ তার গাড়ির ড্রাইভারের কাছ থেকে একটি মোবাইল ম্যাসেজ পেলেন। ড্রাইভারের ম্যালেরিয়া হয়েছে, শরীর ভালো না। তাই তিনি আজ গাড়ি চালাতে আসতে পারছেন না। ম্যাসেজটি পেয়ে মন্ত্রী মহোদয় একটু ঘাবড়ে গেলেন। দু’দিন পরে তার আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হলো। ড্রাইভারটি আর নেই। মারা গেছেন ইবোলা রোগে আক্রান্ত হয়ে। ড্রাইভারের পাশে বসে বহুদিন অফিসে এসেছেন মন্ত্রী। তাই ড্রাইভারের মৃত্যুর পরপর সব সহকর্মীর কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া হলো খোদ পরিবহনমন্ত্রীকেই। ইবোলা রোগের সংক্রমণ যাতে না ছড়ায় এ কারণে এখন চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে, পরিবার-সহকর্মী সবার কাছ থেকে দূরে, অন্য লোকের সংস্পর্শ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে এঞ্জেলা বুশকে।

ঘটনা-২
কাডিয়াটু কান্টা। গিনির মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। ২৬ বছরের এই তরুণীর জীবন ছিল আর সব সহপাঠীর মতোই উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। এক সুখী জীবন কাটছিল তার মেডিকেল কলেজেই। গিনির রাজধানী কোনাকিরির এক ক্লিনিকে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কাজ চলছিল। হঠাৎ একদিন প্রথমে জ্বর, তারপর খিঁচুনি এলো। চিকিৎসকরা আবিষ্কার করলেন তিনি ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত। চলল চিকিৎসা। সুস্থ হয়ে গেলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সনদও দিল। এরপর কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাঙ্গনে ফিরতে চাইলেন কান্টা। ইতোমধ্যে ইবোলা মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে। গিনি, লাইবেরিয়া, সিয়েরালিয়েনে বহু লোক এ রোগে মারা গেছে। পৃথিবীব্যাপী এ নিয়ে শোরগোল উঠেছে। ইবোলা ছোঁয়াচে বলে সুস্থ হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে নেয়নি। চাকরি চলে গেল। পরিবার গ্রামে নিতে ভয় পাচ্ছে। প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সবকিছু ছেড়ে নিজের শহর ছেড়ে অন্য এক শহরে পরিচয় গোপন করে চলছে তার দিন। এখন মনে হচ্ছে ইবোলায় মৃত্যুই ভালো ছিল। সুস্থ হওয়ার পরও ইবোলা আক্রান্ত রোগী হিসেবে সবাই তাকে পরিহার করেছে।

ইবোলা ভয়ঙ্কর
একসময় বাংলাদেশে ওলাওঠা রোগ হতো। গ্রামকে গ্রাম লোক বসন্ত, কলেরা কিংবা ওলাওঠা রোগে সাবাড় হয়ে যেত। মহামারির তোড়ে গ্রামের হাজার হাজার লোক মৃত্যুমুখে পতিত হতো। যারা চিকিৎসা করতেন তারাও আক্রান্ত হতেন এ রোগে। এসব কাহিনী ইতিহাসের বইয়ে লেখা আছে। শুনে মনে হতো কেচ্ছা কাহিনী। তারপরে টিকা, ভ্যাকসিন, প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ার পরে কলেরা, বসন্ত, হাম, ওলাওঠা রোগের কথা আর শোনা যায়নি। হালে পৃথিবীতে সেইরকম এক রোগ ফিরে এসেছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনি, লাইবেরিয়া, সিয়েরালিয়েন, কঙ্গো প্রভৃতি দেশে ইবোলা মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ১৫ অক্টোবর ২০১৪ পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও বা হু) পরিসংখ্যান মতে ইবোলা ভাইরাস ডিজিস (ইভিডি)-এ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৮ হাজার ৯শ ৯৭। এর মধ্যে মারা গেছে ৪ হাজার ৪শ ৯৩।

এ ইবোলা ভাইরাস সংক্রমিত মানুষের মৃত্যুর হার শতকরা ৪৯ দশমিক ৯৪।

ইবোলা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন খোদ চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। ১১-১২ অক্টোবর ২০১৪ পর্যন্ত হু-এর পরিসংখ্যান বলছে, ৪শ ২৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে মারা গেছেন ২শ ৩৬ জন। মৃত্যুর হার শতকরা ৫৫ দশমিক ২৬।

আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুহার সিয়েরালিয়েনে ৭৩.৬৫%, গিনিতে ৫২.৬৩%, লাইবেরিয়াতে ৪৫.৯৭%, নাইজেরিয়াতে ৪৫.৪৫%।

ইবোলা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীও, স্বাস্থ্যকর্মীদের এই মৃত্যুহার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এতটাই চমকে দিয়েছে যে, খোদ জাতিসংঘ এখানে হাত লাগাতে বাধ্য হয়েছে। কোনো মহামারি প্রতিরোধে জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো একটা ইউএন এমার্জেন্সি হেলথ মিশন বানিয়েছে। যার নাম ইউএন মিশন ফর ইবোলা এমার্জেন্সি রেসপন্স (ইউএনএমইইআর)।

ইবোলা: আফ্রিকা টু ইউরোপ-আমেরিকা
ইবোলা শুধু পশ্চিম আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, আমেরিকা এবং স্পেনেও ঢুকেছে। লাইবেরিয়া থেকে দেশফেরত মানুষের মাধ্যমে আমেরিকা ও স্পেনে আঘাত করেছে। ইবোলার চিকিৎসা দিতে গিয়ে দুজন নার্সের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে ইবোলা। যারা আমেরিকায় উচ্চ চিকিৎসা নিয়েও শেষ রক্ষা পাননি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইবোলা আক্রান্ত দেশগুলোর একটি স্তরভিত্তিক তালিকা বানিয়েছে। এই তালিকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থার দেশ হচ্ছে গিনি, লাইবেরিয়া, সিয়েরালিয়েন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে নাইজেরিয়া, সেনেগাল, স্পেন ও আমেরিকা। সম্ভাব্য ইবোলা আক্রান্ত দেশ হিসেবে নাম এসেছে বেনিন, বারকিনা ফাসো, আইভরি কোস্ট, গিনি-বিসাউ, মালি প্রভৃতি দেশের। কঙ্গো-কেও ইবোলা ভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলোর অন্যতম বলে ধরা হচ্ছে। কেননা প্রাপ্ত তথ্যমতে কঙ্গোতে যে ৬৮ জনের শরীরে ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে তার মধ্যে মারা গেছে ৪৯ জন। মৃত্যুর হার ৭২%।

কাজেই এ ছোঁয়াচে রোগটি বিশ্বকর্তাদের মাথায় দুশ্চিন্তা ঢুকিয়েছে বিস্তর। কেননা, ইবোলা ভাইরাসের নিশ্চিত প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। রোগটি ছোঁয়াচে, নানাভাবে সংক্রমিত হতে পারে। ইবোলার ভয়াবহতা এ পর্যায়ে গেছে যে, সিয়েরালিয়েন জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়রা করমর্দন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সিয়েরালিয়েন জাতীয় দলের ফুটবল খেলোয়াড়রা যে হোটেলে উঠেছে, ভয়ে সে হোটেলের সমস্ত বোর্ডার হোটেল ছেড়ে চলে গেছে।

মনরোভা: মৃত্যুপুরী
লাইবেরিয়াতে ইবোলা প্রবলভাবে আঘাত করেছে। সে দেশের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ইবোলা রোগ চিকিৎসার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের অভাব মৃত্যুর হার বাড়িয়েছে। রেড ক্রিসেন্ট লাইবেরিয়াতে শুধু মৃতদেহ সরানো এবং আক্রান্ত রোগী লোকালয় থেকে পৃথক করানোর কাজেই হিমশিম খাচ্ছে। টাইম ম্যাগাজিন (অক্টোবর ১৪, ২০১৪) ইস্যুতে প্রকাশিত এক সংবাদ অনুযায়ী লাইবেরিয়াবাসী একজন ক্ষোভসহকারে অভিযোগ জানিয়ে বলছেন, ‘নো ওয়ান কামস হোয়েন উই আর সিক, অনলি হোয়েন উই আর ডেড’।

অর্থাৎ যখন জ্বর হচ্ছে, খিঁচুনি হচ্ছে, তখন ডেকে কাউকে পাচ্ছি না। কোনো অ্যাম্বুলেন্স আসছে না। যখন আমরা কেউ অসুস্থ হচ্ছি তখন পাশে কাউকে পাচ্ছি না। যখন মরছি তখন মৃতদেহ সরাতেই অ্যাম্বুলেন্স মিলছে।

ইবোলার ভয়ে চার্চে প্রার্থনারত মানুষ কেউ কারও গা ঘেঁষে বসতে চাইছে না। করমর্দন করছে না। বাবা-মা’রা সন্তানদের খেলার জন্য অন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশতে দিচ্ছেন না। পপুলার ডান্স ক্লাব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়েছে। ইবোলা আক্রান্ত মৃতদেহগুলোর সৎকার অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কেননা মানুষ ভাবছে প্রত্যেক মৃতদেহই ইবোলা ভাইরাসের আধার। লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভার অফিস, শপিংমলগুলোতে নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে আর বন্দুক থাকছে না, থাকছে থার্মোমিটার। কেননা ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে উচ্চ মাত্রার জ্বর।

সারাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে বলে ক্লিনিক, হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা ব্যবস্থায়। ফলে সাধারণ রোগ ডায়েরিয়া, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিক চিকিৎসা বন্ধ হয়ে পড়ছে। চিকিৎসার অভাবে এসব রোগেও লোক মরছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মীর ভাষ্য হচ্ছে, ‘ইবোলা হ্যাজ সাকড দ্য এয়ার আউট অফ হেলথ কেয়ার’।

পুরো দেশের অর্থনীতি ইবোলা ভয়ে সংক্রমিত।

ভয় বাড়ছে
বিবিসি রেডিওর সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, জাতিসংঘের ইবোলা মিশনের প্রধান এন্টনি ব্যানবেরি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে বলেছেন, এখনই ইবোলা দমন করতে না পারলে বিশ্ব এমন এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে যা মোকাবিলার কোনো পরিকল্পনা এখনও নেই। তার মতে, এই ভাইরাসের বিস্তারকে সামাল দেয়ার চেষ্টায় বিশ্ব যে চেষ্টা করছে তাতে তারা পিছিয়ে পড়ছে।

এন্টনি ব্যানবেরির ভাষায়, ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে নতুন করে ১০ হাজার মানুষ ইবোলায় আক্রান্ত হবে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহকারী মহাপরিচালক ব্রুস আইলওয়ার্ড জানিয়েছেন, যারা ইবোলায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের শতকরা ৭০ জনই মারা যাচ্ছেন।

নাইজেরিয়ায় সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘের শান্তি মিশনে নিয়োজিত এক হাজার তিনশ’র বেশি নাইজেরীয় সৈন্যকে মানুষের সংসর্গ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। এই সৈন্যদের শিবিরে প্রবেশ করেছিলেন এমন এক ব্যক্তি পরে ইবোলা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

ইবোলা রাজনীতি
লাইবেরিয়া, গিনি, সিয়েরালিয়েন পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ। তবে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ঔপনিবেশিক কলোনি ছিল আফ্রিকার এ দেশগুলো। এসব দেশের কাঁচামাল, প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করে তার সুফল ঘরে এনেছে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি। কলা, কফি, বিন, পামওয়েল, বাদাম চাষ করে তার মুনাফা বছরের পর বছর ঘরে তুলেছে ফ্রান্স। বক্সাইটের এক বড় আধার গিনি। পৃথিবীর ২৫ শতাংশ বক্সাইট মজুত আছে গিনিতে।

সর্ববৃহৎ রাবার উৎপাদনকারী দেশগুলোর অন্যতম লাইবেরিয়া। ব্রিটিশ কলোনি ছিল দেশটি। স্বাধীনতা পায় ১৯৬১ সালে। আফ্রিকান আমেরিকানরাই এ দেশের হর্তাকর্তা এখনও। ইবোলা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে প্রায় তিন হাজার সেনা লাইবেরিয়ায় পাঠিয়েছে আমেরিকা। লাইবেরিয়া, সিয়েরালিয়েনে গৃহযুদ্ধে ইন্ধন দিয়ে ১৯৮৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত তা জিইয়ে রেখেছে পশ্চিমা সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি। এখন আবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে এক ধরনের করদ রাজ্য করে রেখেছে তারাই। অনেকের ধারণা, গিনি-লাইবেরিয়া-সিয়েরালিয়েনের প্রাকৃতিক সম্পদ বক্সাইট, টিন, হীরা খনির ওপর কর্তৃত্ব রাখতে চায় পশ্চিমারা। ইবোলা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের নামে এ আধিপত্য কতদূর গড়ায় দেখার বিষয় সেটাই।

ষড়যন্ত্রতত্ত্বে ইবোলা ও জীবাণু অস্ত্র
যারা যেকোনো বিষয়কে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত তারা ‘ইবোলা’ নিয়ে পশ্চিমা ক্ষমতাশালী দেশগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে যে তৎপরতা দেখাচ্ছেন তাও খুব স্বাভাবিক নয়। ইতোমধ্যে ‘ইবোলা’ বিষয়ে মনোযোগ দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার সকল বিদেশ সফর স্থগিত করেছেন। তিনি তার মিত্র সকল ক্ষমতাবান পশ্চিমা দেশগুলোর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে এ বিষয়ে হটলাইনে যোগাযোগ রাখছেন। মার্কিনিদের এই অতি উৎসাহ অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। সন্দেহবাদীরা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আলোক যেসব বিষয় নিয়ে ভাবছেন, তা হলো-

এক. ‘ইবোলা’ ভাইরাস যে পরিমাণ প্রাণসংহার করছে, আধুনিক বিশ্বে তা বিরল। তাই অনেকেই সন্দেহ করছে, ‘ইবোলা সংক্রমণ’ ঘটনার মধ্য দিয়ে পশ্চিমারা কোনো জীবাণু অস্ত্রের পরীক্ষা করছে কিনা?

দুই. লাইবেরিয়া, গিনি, সিয়েরালিয়েনসহ সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকা যখন চীন ও এশিয়ার অর্থনৈতিক বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠছে, তখন এরকম প্রাণঘাতি রোগের আবির্ভাব সন্দেহজনক। পশ্চিম আফ্রিকাসহ পুরো আফ্রিকা মহাদেশ অর্থনৈতিক বিনিয়োগের জন্য ভার্জিন ল্যান্ড হিসেবে বিবেচিত। চীন এখানে খনিতে এবং কৃষিজমিতে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। এশিয়ার অনেক দেশ আফ্রিকার খনিজ সম্পদ ও ভূমির সুযোগ গ্রহণ করে সেখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। প্রাণঘাতি ‘ইবোলা রোগ’ সেই সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই সন্দেহবাদীরা প্রশ্ন তুলছে, পশ্চিমা ক্ষমতাবানরা চক্রান্ত করে আফ্রিকায় চীন ও এশিয়ার অর্থনৈতিক বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই এ ইবোলা-ভীতি শুরু করেছে।

তিন. অনেক সন্দেহবাদীর ধারণা, ইবোলা রোগ ছড়িয়ে এরকম ভাইরাসজনিত রোগের প্রতিষেধক পরীক্ষা করতে চায় পশ্চিমা দেশগুলো। তাই দরিদ্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোকে একধরনের গিনিপিগ বানিয়ে পশ্চিমা ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের প্রতিষেধক কতটা কার্যকর তার পরীক্ষার সুযোগ নিচ্ছে কেবল।

চার. এই ইবোলা দুর্যোগ ঘটিয়ে পুরো আফ্রিকাকে তার পুরনো পশ্চিমা ঔপনিবেশিকরা নতুন করে দখল নিতে চাইছে। পশ্চিমা ক্ষমতাধর দেশগুলোর বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যাতে এখানকার অর্থনীতি, রাজনীতি আর বাণিজ্যের সম্ভাবনায় ভাগ না বসাতে পারে এ ইবোলা দুর্যোগ তাই কৌশলে ঘটানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ইবোলা
পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ইবোলা ভাইরাস। ইতোমধ্যে বহু লোক মারা গেছে। ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী ঘোষণা করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। পশ্চিম আফ্রিকাতে বিভিন্ন শান্তি মিশনে কর্মরত রয়েছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর শান্তিরক্ষীরা। বেসামরিক অনেক মানুষ এই সূত্রে লাইবেরিয়া, কঙ্গো, সিয়েরালিয়েনে কর্মরত। যাদের মাধ্যমে বাংলাদেশেও চলে আসতে পারে এই ভাইরাস।

এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কৃত হয়নি এখনও। নেই কোনো কার্যকর ওষুধ। তাই নেই তেমন কোনো চিকিৎসাও। এই প্রাণঘাতি ‘ইবোলা ভাইরাস’ শনাক্ত করার কোনো ধরনের ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেই বাংলাদেশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ। একজন আক্রান্তের সংস্পর্শে এলেই আক্রান্ত হচ্ছে অপরজন। মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ঘটাতে পারে ভয়াবহ দুর্যোগ।

যদিও বাংলাদেশ সরকার বলছে লাইবেরিয়া, সিয়েরালিয়েন, কঙ্গোতে কর্মরত বাংলাদেশিরা সবাই সুস্থ রয়েছেন। তবে লাইবেরিয়াতে কর্মরত ছয়জন বেসামরিক ব্যক্তি সম্প্রতি দেশে এসেছেন। বিমানবন্দর থেকে ছাড়া পেলেও এখন পড়েছেন মিডিয়া, স্বাস্থ্যকর্মী আর উৎসুক জনতার খপ্পরে। ইবোলায় আক্রান্ত হওয়ার গুজবে তাদের জীবন এখন বিপদাপন্ন প্রায়।

ঝুঁকির কবলে আমরা
ইবোলার কারণে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে তা ভয়াবহ। ইবোলা ভাইরাসের এই বিপদ শক্তি যদি অপ্রতিহত থাকে তবে তার প্রভাব খুব দ্রুতই সারা বিশ্বকে ভয়ঙ্কর এক পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। যুদ্ধ, বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব যে প্রাণসংহার ঘটাতে পারেনি, এই ইবোলা ভাইরাস তার চাইতে বিপুল মানুষের জীবন বিপন্ন করতে পারে। দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফাঁক গলে এ রোগ শুধু আফ্রিকা নয় বিশেষত এশিয়ার ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জীবন হুমকিতে ফেলতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান এশিয়ায় এই রোগ যদি ঘাঁটি গাড়ে তবে তা বহুদিনের কষ্টার্জিত বৈষয়িক সম্ভাবনাকে ভণ্ডুল করে দিতে পারে।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটা বড় ঝুঁকি রয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে দুর্বল অবস্থায় আমরা আছি এবং আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা যতটা নাজুক, তাতে ইবোলা সংক্রমণ বাংলাদেশকে মারাত্মক বিপদাপন্ন করতে পারে। ইবোলা ভাইরাস যেহেতু চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদেরও জীবন বিপন্ন করছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে এ রোগের সংক্রমণ ঘটলে, তা প্রাণহানি তো বটেই অনেক রকম সামাজিক সমস্যাও তৈরি করতে পারে।

গার্মেন্ট খাতসহ বিভিন্ন শিল্পখাতে আফ্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আফ্রিকার নানা দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে। ক্লাব ফুটবলে আফ্রিকান খেলোয়াড়দের আনাগোনা রয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে উৎসাহী, উদ্যোগ রয়েছে বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের। পশ্চিম আফ্রিকাসহ আফ্রিকা মহাদেশে কৃষি ও শিল্পখাতে বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের উজ্জ্বল সম্ভাবনা সূত্রেও বাংলাদেশে আফ্রিকার মহাদেশের লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। এর বাইরে দেশি-বিদেশি এনজিওর কর্মকাণ্ড সম্পৃক্ত দেশের ও বিদেশের অনেকেই আফ্রিকায় যাতায়াত করেন কর্মের প্রয়োজনেই। সুতরাং নানাভাবে ইবোলা ঢুকতে পারে বাংলাদেশে। শুধু বিমানবন্দর নয়, সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়েও ইবোলা ঝুঁকি বাড়তে পারে বাংলাদেশের। এক্ষেত্রে বিমানবন্দরেই তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। সমুদ্রবন্দর এবং স্থলবন্দরের ইবোলা ঝুঁকি মোকাবিলা অবস্থা কেমন, তা সহজেই অনুমেয়। পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইবোলার আগমন ঘটতে পারে এদেশে। আন্তর্জাতিক মহলে ইবোলা নিয়ে যে তোড়জোড় শুরু হয়েছে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশে আরও অধিক সতর্কতা এবং সক্রিয়তা জরুরি। নইলে এক বড় বিপদ আমাদের অর্থনীতি এবং সমাজকে বিপদাপন্ন করতে পারে। আমাদের কষ্টার্জিত অনেক অর্জন বিপদের মুখে পড়তে পারে।

ইবোলা কি
ইবোলা ভাইরাস আগে রক্তপ্রদাহজনিত জ্বর [ইবোলা হেমোরেজিক ফিভার (ইএইচএফ) হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিল। ইবোলা মূলত একটি আরএনএ ভাইরাস। ইবোলা ভাইরাস গোত্রের ৫টির মধ্যে ৩টি প্রজাতি মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়ে গুরুতর অসুস্থ করার ক্ষমতা রাখে। বাকি ২টি মানুষের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে জায়ারে ইবোলা ভাইরাস। জায়ার হলো একটি জায়গার নাম যেখানে সর্বপ্রথম এই ভাইরাসে কোনো মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ছিল শতকরা ৯০ শতাংশ। ভয়াবহ এই ভাইরাসটি মানবদেহে রক্তপাত ঘটায়। লিভার, কিডনিকে অকেজো করে দেয়, রক্তচাপ কমিয়ে দেয়, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কমিয়ে দেয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত করে।

ইবোলা ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশের পর কয়েকদিন থেকে প্রায় ৩ সপ্তাহ কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করেই অবস্থান করতে পারে। অর্থাৎ এর লক্ষণসমূহ পরিলক্ষিত হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ২১ দিন লাগতে পারে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি এই রোগ নিয়ে চলে যেতে পারেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে। আর সেখানে ছড়িয়ে দিতে পারেন নিজের অজান্তেই।

ইবোলার লক্ষণ
ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে নিরীহ ফ্লু’র মতো হালকা জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা অনুভব করে। কিছুদিন পর তীব্র মাথাব্যথা, জ্বর, শরীর ব্যথা, ত্বকে দানা দানা ওঠা, মুখে ঘা, ডায়রিয়া এবং মারাত্মক বমি শুরু হতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে শরীরের ভেতরে বাইরে রক্তপাত শুরু হতে পারে। এই ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার, কিডনি, হার্ট অকেজো করে দেয় যার ফলে রোগীর মৃত্যু ঘটে।

এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণ ফ্লু’র মতোই। সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, বমি, ডায়রিয়া এবং জ্বর। তাই কারও উপরোক্ত কোনো উপসর্গ দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে এটা ম্যালেরিয়া, হ্যাপাটাইটিস, কলেরা বা অন্য কোনো রোগের জীবাণুর কারণে হচ্ছে কিনা।

কীভাবে ছড়ায়
বলা হয়ে থাকে বাদুড়ের খাওয়া ফল থেকেই ইবোলা ভাইরাস মানুষের দেহে প্রথম প্রবেশ করে। এবং পরবর্তীতে তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে শুরু করে। ইবোলা আক্রান্ত মানুষের দেহরস অপর কোনো মানুষের স্পর্শে এলে সেই ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পরও ভাইরাসটি বেশ কয়েকদিন টিকে থাকে।
আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে না আসলে এই রোগে সংক্রমিত হবার ভয় নেই।

ইবোলার নাম
মধ্য আফ্রিকার উত্তরাংশে কঙ্গোর উপত্যকায় প্রবাহিত ইবোলা নদী থেকে ইবোলা ভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে এ ভাইরাসের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়। মার্বুগ ভাইরাসের সঙ্গে এ ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে যা ১৯৬৭ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। ইবোলা ভাইরাসের পাঁচটি ভিন্ন নাম রয়েছেÑ ইবোলা-জায়ারে, ইবোলা-সুদান, ইবোলা-আইভোরি কোস্ট, ইবোলা-রেস্টন এবং ইবোলা-বুন্দিবুগিও। এ নামকরণগুলো ছড়িয়ে পড়া এলাকার নামানুসারে হয়েছে।

ইবোলাকে কেন ভয়
এখন পর্যন্ত এই রোগটির কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। এটি ছোঁয়াচে, সাধারণত শরীরের অভ্যন্তরীণ তরলের মাধ্যমে এই রোগটি ছড়ায়, এমনকি মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির শরীরেও এই রোগের ভাইরাস জীবিত অবস্থায় থাকে এবং তা জীবিত মানুষকে সংক্রামিত করার ক্ষমতা রাখে। ১০ জন আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুর সম্ভাবনা।

-শুভ কিবরিয়া

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend