বর্ধমান বিস্ফোরণে জেএমবিই জড়িত, নেটওয়ার্ক ছিল গোয়েন্দাদের অজানা
বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদিনের (জেএমবি) সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)।
বিবিসি বাংলা জানায়, বর্ধমানে তৈরী হওয়া বোমাগুলি বাংলাদেশে পাঠানোর জন্যই তৈরী করা হচ্ছিল বলেও দাবি করেছে এনআইএ। গোয়েন্দা সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা বর্ধমানের খাগড়াগড়ে ২ অক্টোবরের বিস্ফোরণের প্রাথমিক তদন্ত শেষ করেছে- দুই মহিলা সহ তিনজনকে তারা গ্রেপ্তার করতে পেরেছে আর চতুর্থ ব্যক্তি বিস্ফোরণে আহত হয়ে এখনও হাসপাতালে।
শাকিল আহমেদ এবং শোবহান মন্ডল নামে যে দুই ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিলেন– তাঁরাও বাংলাদেশের নাগরিক বলেই মোটামুটি নিশ্চিত এনআইএ। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ও বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ সহ বিভিণ্ন জেলায় তল্লাশী চালিয়ে উদ্ধার হওয়া নথিপত্র, ফোন রেকর্ড প্রভৃতি ঘেঁটে এনআইএ এখন নিশ্চিত যে, জামায়েতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের সদস্য এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশে পাঠানোর জন্যই নিষিদ্ধ ওই সংগঠনটির সদস্যরা অত্যাধুনিক বোমাগুলি তৈরী করছিলেন।
গোয়েন্দা সূত্রগুলি জানিয়েছে, এই বিস্ফোরণের মাধ্যমে যে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে– যেটা বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড বা তেলেঙ্গানা পর্যন্ত বিস্তৃত– তা একরকম নতুন এবং অজানাই ছিল গোয়েন্দাদের কাছে।
এখন জামায়েতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের এই নেটওয়ার্ক যেমন খুঁজে বার করতে চাইছে এনআইএ, তেমনই জেএমবি-র এই নেটওয়ার্কের ফান্ডিং কীভাবে হত– অর্থাৎ কারা টাকা পয়সা যোগাত এই সন্ত্রাসীদের– সেটাও খুঁজের বার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থাটি। আর তথ্য পাওয়ার জন্য আর্থিক পুরস্কারও ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
তবে গত ১৮ অক্টোবর এই ঘটনার সাথে শ্রীলঙ্কার বিলুপ্ত তামিল টাইগারদের নাম উঠে আসে। ভারতের ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (এনএসজি) জানায়, এলটিটিই (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম)-এর ব্যবহার করা বিস্ফোরকের সাথে বর্ধমানের বিস্ফোরকের মিল রয়েছে।
এলটিটিই-র পতন ঘটলেও কেন এই সংস্থাটির নাম উঠে আসছে- এমন প্রশ্নের জবাবে সেসময় এনএসজি-র প্রাক্তন কর্তা এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দীপাঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ভুলে যাবেন না, সম্প্রতি ছত্তীসগড়ে মাওবাদীদের বিস্ফোরণের ঘটনাতেও এলটিটিই-র ছাপ পেয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতর। সংগঠন হিসেবে এলটিটিই-র এখন আর অস্তিত্ব না থাকলেও যে পাকা মাথার যুবকেরা এলটিটিই-র জন্য বিস্ফোরক বানাতো, তারা রয়েই গিয়েছে।
এদিকে গত ১৬ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশেই নাশকতার পরিকল্পনা ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদিনের (জেএমবি)।
ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) সেসময় জানায়, তারা পশ্চিমবঙ্গের চারটি জেলা নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের বিভিন্ন গোপন গুদামে অসংখ্য আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্লপ্লোসিভ ডিভাইস) মজুত করা আছে বলে জেনেছে।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণে আহত আব্দুল হাকিম ওরফে হাসানকে (২৩) জিজ্ঞাসবাদের পর এসব তথ্য জেনেছে বলে জানিয়েছে এনআইএ।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, ভারতে যে ৩৬টি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের তালিকা এনআইএ তৈরি করেছে, তার ২৭ নম্বরে রয়েছে জামায়াতুল মুজাহেদিন।
এনআইএ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে হাকিম জানিয়েছে- নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমান এই চার জেলায় শত শত আইইডি মজুত করে রাখা আছে বিভিন্ন গোপন গুদামে। প্রতি জেলায় ওই রকম একাধিক গুদাম রয়েছে বলে হাকিমের বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত পেয়েছেন গোয়েন্দারা। আর সেগুলিতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে, এ জন্যই এই ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত এনএসজি (ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড)-র সহায়তা চেয়েছে এনআইএ।
এদিকে গোয়েন্দাদের বক্তব্য, বিস্ফোরণে নিহত শাকিল ও সুবহান বাংলাদেশেরই জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর সদস্য। এনআইএ-র ধারণা, জেএমবি বাংলাদেশে যে রকম জেহাদি কার্যকলাপ করে, তেমনই নাশকতা হাকিম ও তার দলবল ভারতেও ঘটানোর চেষ্টা করছিল।
অপরদিকে কলকাতার বর্তমান পত্রিকা গত ৭ অক্টোবর জানায়, গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের ২৩ তারিখে ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় পুলিশ খুন করে দুই জঙ্গী নেতাকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো যে দলটি তারাই ঘাঁটি গেড়েছিলো বর্ধমানে। তার আগে এই দলটিই মুর্শিদাবাদের লালবাগ এলাকায় সাময়িক আস্তানা গেঁড়ে জিহাদী নিয়োগের কাজ চালাচ্ছিলো। শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতে বড়সড় নাশকতার ছক রূপায়নের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলো জঙ্গী দলটি।
বর্তমান পত্রিকা’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মার্চ মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নয়াদিল্লীকে এই বিষয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়ে বলা হয়েছিলো, বাংলাদেশে বড়সড় নাশকতার ছক কষতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঘাঁটি গেঁড়েছে জঙ্গিরা। এমনকি পালাতক জঙ্গি নেতাদের নামও দেয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। গোয়েন্দারা বলছেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ,মালদহ, বর্ধমান, বীরভূম জেলা থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো জঙ্গিরা। এমন পুরো অর্থও যেত বাংলাদেশ থেকে।
এদিকে গত ১০ অক্টোবর দৈনিক জনকণ্ঠ তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, জেএমবির জঙ্গীদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে বাংলাদেশ ঘুরে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে টাকার যোগান গেছে বলে খোঁজ পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। দুবাইয়ের মাদক ও চোরাকারবারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা পেয়েছে বাংলাদেশের জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেই টাকা গেছে বর্ধমানের জঙ্গীদের হাতে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ, জামায়াতী ব্যবসায়ী, সারদা গ্রুপ জঙ্গী কেলেঙ্কারীর অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে খগড়াগড়ে একটি বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে দুই জন নিহত হন। তারা নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) একটি শাখার সদস্য বলে সেসময়ই সন্দেহ করে ভারতীয় গোয়েন্দারা।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা অনলাইন, আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান পত্রিকা, দৈনিক জনকণ্ঠ