মোবাইল নম্বর না পাল্টে অপারেটর বদল এ বছরও হচ্ছে না
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা উদ্যোগ, আলোচনা ও নির্দেশনার ফল শূন্য। বাংলাদেশে মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) বা ফোন নম্বর অপরিবর্তিত রেখে মোবাইল অপারেটর পরিবর্তন করার সুবিধা এখনো চালু হয়নি। এ বছর হচ্ছে- এমন সম্ভাবনাও নেই। অথচ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি গত বছরের ১৩ জুন মোবাইল ফোন অপারেটরদের এমএনপি সুবিধা বাস্তবায়ন করতে একটি নির্দেশনা জারি করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, আগামী সাত মাসের মধ্যেই গ্রাহকদের এমএনপি সুবিধা দিতে হবে।
১৫ বছর আগেই কয়েকটি দেশে এমএনপি সুবিধা চালু হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে চালু হয়েছে ২০১১ সালের শুরুতেই। পাকিস্তানে চালু হয়েছে তারও আগে, ২০০৭ সালের শুরুতে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এ সুবিধা চালু হয়েছে ২০০৮ সালে। আর হংকং, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসে এই সুবিধা প্রথম চালু হয় ১৯৯৯ সালে। বর্তমানে প্রায় ১০০টি দেশে এ সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে এমএনপি কবে চালু হতে পারে- এ প্রশ্নে বিটিআরসির কর্মকর্তারা সম্প্রতি আর কোনো মন্তব্য করছেন না। তবে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের সেক্রেটারি জেনারেল টি আই এম নূরুল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে এয়ারটেল বাংলাদেশ ২০১০ সালে এমএনপি সেবা চালুর পক্ষে মত দেয়। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর ‘এয়ারটেল বাংলাদেশ’-এর যাত্রা শুরুর দিন প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ক্রিস টবিট কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের উচিত এমএনপি ব্যবস্থা চালু করা।
বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর শেষে গত বছরের ১৩ জুন বিটিআরসি মোবাইল ফোন অপারেটরদের এমএনপি সুবিধা বাস্তবায়ন করতে একটি নির্দেশনা জারি করে। এতে বলা হয়, ‘এমএনপি সুবিধা দিতে অপারেটররা গ্রাহকদের কাছ থেকে ৫০ টাকার বেশি নিতে পারবে না। আগামী সাত মাসের মধ্যেই গ্রাহকদের এমএনপি সুবিধা দিতে হবে। এ নির্দেশনা জারির দিন থেকে তিন মাসের মধ্যে অপারেটরদের এমএনপি সেবা শুরুর লক্ষ্যে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করতে হবে। বিটিআরসির একজন কমিশনার কনসোর্টিয়ামের বোর্ড মেম্বার থাকবেন। কনসোর্টিয়ামই এ সেবা চালুর সব ব্যয় বহন করবে। কনসোর্টিয়াম গঠনের তিন মাসের মধ্যে অপারেটরদের এমএনপি সিস্টেম স্থাপন করতে হবে, তার এক মাস পর পরীক্ষামূলকভাবে অপারেটরদের এ সেবা শুরু করতে হবে।’
নির্দেশনায় আরো বলা হয়, এমএনপির জন্য আবেদনের তিন দিনের মধ্যে এ সেবা দিতে হবে এবং কোনো গ্রাহক যদি একবার অপারেটর বদলের পর আবারও অপারেটর বদল করতে চান তাহলে তাঁকে ৪৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৪৫ দিন অপারেটরের সেবা নিতে হবে। প্রি-পেইড ও পোস্ট পেইড- উভয় ধরনের গ্রাহকই এমএনপি সুবিধা পাবেন।
২০১১ সালের আগস্টে বিটিআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, ‘এমএনপি সেবার বিভিন্ন কারিগরি দিক সম্পর্কে বিটিআরসিতে প্রজেকশন চলছে। আমরা এর মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের মত নিচ্ছি। এমএনপি সেবা পরিচালনায় ইন্টার-কানেকশন এক্সচেঞ্জগুলো (আইসিএক্স) ব্যবহার করা যায় কি না তাও খতিয়ে দেখছি। আইসিএক্সের মাধ্যমে সেবাটি দেওয়া গেলে মোবাইল অপারেটরদের কাছে নতুন করে সংযোগ নিতে হবে না। আইসিএক্সে তাদের যে সংযোগ রয়েছে সেটাই কাজে লাগানো যাবে। তবে এ সেবার জন্য আইসিএক্সগুলোকেও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সংগ্রহ ও সংযুক্ত করতে হবে।’
এর কয়েক মাস পর টু-জি মোবাইল লাইসেন্সের গাইডলাইনে অপারেটরদের জন্য এমএনপি চালু করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়। এর প্রায় দুই বছর পর বিটিআরসির ওই নির্দেশনা জারি হয়। কিন্তু এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের অপ্রস্তুতি এবং জিয়া আহমেদের অকাল মৃত্যু এমএনপি চালুর উদ্যোগ গতি হারায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিটিআরসির বর্তমান চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা ও তাদের মতামতের ভিত্তিতে এমএনপি সেবা চালুর পক্ষে অবস্থান নেন। বিটিআরসি কয়েক মাস আগে এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য অ্যামটবের সেক্রেটারি জেনারেল টি আই এম নূরুল কবীরের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেয়।
কমিটির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে টি আই এম নূরুল কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা একটি প্রতিবেদন বিটিআরসিকে দিয়েছি। এমএনপি সুবিধা চালুর পথে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গভর্ন্যান্স, কমার্শিয়াল, টেকনিক্যাল- এসব বিষয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। পাশের দেশগুলোতে কিভাবে এ সেবা চলছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।’
গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেন বলেন, এ সেবা চালুর পথে কোনো বাধা নেই। তবে এটি চালুর প্রক্রিয়াটিকে সহজ করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কনসোর্টিয়াম গঠন কিভাবে হবে, যন্ত্রপাতি কোথায় কিভাবে বসবে, এসব ঠিক করতে হবে। সিম-ট্যাক্সের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা গ্রাহককে একটি সিম দিচ্ছি দেড় শ টাকায়। কিন্তু এর পেছনে অনেক খরচ রয়েছে। যে অপারেটরের কাছে গ্রাহক সিম কিনছে একটা সময় পর্যন্ত গ্রাহককে সেই অপারেটরের সঙ্গে থাকতে হবে। সে সময় কত দিন হবে সেটাও ঠিক করতে হবে। অপারেটর বদলের সময় ব্যালান্স ট্রান্সফারের বিষয়টিও রয়েছে। এসব বিষয় সম্পর্কে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিটিআরসির গত বছরের নির্দেশনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ওই নির্দেশনা জারি হয়নি।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বছর এ সেবা চালু করা সম্ভব হবে না।’