তারেক রহমানের নতুন ভাবনা এবং কিছু কথা -সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে নেই। তিনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। দেশ, জনগণ এবং বিএনপি নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। কেমন করে দেশের উন্নয়ন এবং একই সাথে বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা যায়- সেই সব নিয়ে তিনি তার পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন।
তারেক রহমান শ্যাডো কেবিনেটের ন্যায় তার বিভিন্ন উপদেষ্টা নিয়োগ করছেন, যা রাজনীতিতে অনেক গুণগত পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা নেত্রীরা তাদের উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাম-লী সাজিয়ে থাকেন, তাদের কাজের সহযোগিতার জন্য। কিন্তু উপদেষ্টা কিংবা উপদেষ্টা পরিষদ নিয়োগের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের তাবৎ বড় বড় বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রসেস এবং পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে।
আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদাহরণ এখানে এ কারণেই টেনে নিয়ে আসছি, কারণ একজন তারেক রহমানকে আমি দেখি আগামী দিনের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। সুতরাং ভাবী প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি একশন, পদক্ষেপ কেমন হওয়া উচিত, এ নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণ সময়ের দাবি রাখে। আমাদের দেশে সব চাইতে বড় যে সমস্যা, তা হলো কারো কোন কাজের সঠিক বিশ্লেষণ করা হলে ধরে নেয়া হয় বিরোধিতা করা হচ্ছে কিংবা সেই সমালোচনার কারণে সমালোচিত ব্যক্তির প্রচারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ট্রেডিশন এখানে দাঁড়িয়ে গেছে। আমার এই বিশ্লেষণকে দেখতে হবে সম্পূর্ণ নির্মোহ এবং বাস্তবতার আলোকে, সত্যিকারের গঠনমূলক আলোচনার আলোকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর, এমনকি প্রেসিডেন্টেরও কাজের সহযোগিতা, সঠিক ও তথ্য নির্ভর পরামর্শ দেওয়ার জন্য (পলিসি মেকিং ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে) উপদেষ্টা রয়েছেন। বর্তমানে ব্রিটেনের প্রধান প্রধান তিনটি দলের যেমন কনজারভেটিভ, লেবার আর লিবডেমের তিন নেতা ডেভিড ক্যামেরন, মিলিব্যান্ড, নিক ক্লেগেরও উপদেষ্টা রয়েছেন। সম্প্রতি লেবার দলের নেতা মিলিব্যান্ড আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্যে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্যে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্বাচনী এডভাইজার ডেভিড এক্সেল রডকে বিলিয়ন ডলার দিয়ে হায়ার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য- আগামী নির্বাচনে লেবার দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য নির্বাচনী কৌশল ও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক পলিসি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ। এক্সেল রডের বিশ্বব্যাপী ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্ট ওবামাকে আমেরিকার জনগণের ভাগ্য “বদলে দেয়ার” অঙ্গীকার দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসার নেপথ্যের কারিগর। মিলিব্যান্ডের পথ ধরে কনজারভেটিভ পার্টিও বসে নেই। তারাও ওবামার সাবেক নির্বাচনী এডভাইজর জিম ম্যাসিনা এবং অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনের মাস্টার মাইন্ড লিনটন ক্রসবীকে নিয়োগ দিয়েছেন। এ দু’টি সংবাদ আমি ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল থেকে নিশ্চিত তথ্য প্রদান করলাম। লিবারেল ডেমোক্রেটও সাউথ আফ্রিকার এক্সপার্ট রাইয়ান কোটজীকে হায়ার করে নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ এডভাইজর নিয়োগ দোষের কিছু নয়। বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া, সেটা ভালো দিক। তবে সেটা হতে হবে দেশ, দল এবং নেতাকে সহযোগিতা ও উপকৃত করতে পারেন এমন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বিশেষজ্ঞবৃন্দ নিয়ে।
তারেক রহমান এ পর্যন্ত যতজন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে দু’জন ব্যতিরেকে বাকি সবাই ব্যারিস্টার উপাধিধারী। সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া তিনজন ব্যারিস্টার সহ দু’জন প্রফেশনালও রয়েছেন। গুগল এবং ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস আর্কাইভস সার্চ করে ও বিভিন্ন অফিসিয়াল সূত্রে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে, উপদেষ্টাদের একজন ছাড়া অন্যদের ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস কিংবা লোকাল গভর্নমেন্ট বা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে কাজ করার একদিনেরও বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। আমি কাউকে ছোট কিংবা কারো পক্ষে বা বিপক্ষে বলছি না, এমনকি তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত সঠিক না বেঠিক আমি সেসবের কোন কিছুই এখানে আলোচনা করতে চাই না। আমার যা উদ্দেশ্য, একজন নেতা যিনি ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী হতে চান তাকে সহযোগিতা দেয়ার জন্যে উপদেষ্টা হবে সেসব ক্ষেত্রে দক্ষ এবং হতে হবে ট্র্যাক রেকর্ডের অধিকারী- যাতে নেতা যেমন সঠিক সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ করতে পারেন, একই সাথে দেশ ও দল উপকৃত হয়।
কেননা, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে একজন অখ্যাত বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতকে ডেকে নিয়ে ঢাকার মেয়র করেছিলেন, যার বর্তমানে কোন খবরই নেই। শহীদ জিয়া আরো এক বিলেত ফেরত ছাত্র শক্তি থেকে ব্যারিস্টার মওদুদকে ডেকে নিয়ে প্রথমে উপদেষ্টা পরে মন্ত্রীও বানিয়েছিলেন, তিনিও আজকে প্রশ্নবোধক বই লিখে বিএনপি ও তারেক রহমানকে বিব্রত করার চেষ্টায় আছেন। শহীদ জিয়া শাহ আজিজকে ডেকে এনে মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই দিয়েছিলেন, অথচ এই শাহ আজিজ সহ উপরোক্ত দুই ব্যারিস্টার বিএনপির দুর্দিনের সময় দল ছেড়ে গিয়ে দলের সব চাইতে ক্ষতি করেছিলেন। একই অবস্থা আমরা দেখেছি ডা. মতিন, শামসুল হুদা এদের ক্ষেত্রেও। এদেরকেও শহীদ জিয়া এনে পরিচিতি দিয়েছিলেন। বিগত জোট সরকারের সময় তারেক রহমানের সরলতা আর বাবার মতো উদার মনের পরিচয়ে অনেকেই অফিসে কাজ করার সুবাদে তারেক রহমানের জন্য দুর্নাম বয়ে এনে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন, অথচ দুর্নামের ভাগীদার হতে হয়েছে তারেক রহমানকে।
উপদেষ্টা নিয়ে সুন্দর বক্তব্য আছে উইকিপিডিয়াতে, যা এখানে হুবহু তুলে ধরলাম, An adviser or advisor is normally a person with more and deeper knowledge in a specific area and usually also includes persons with cross functional and multidisciplinary expertise. An adviser’s role is that of a mentor or guide and differs categorically from that of a task specific consultant. An adviser is typically part of the leadership, where as consultants fulfill functional roles.[1]
The spellings adviser and advisor have both been in use since the sixteenth century.[2] Adviser has always been the more usual spelling, though advisor has gained frequency in recent years and is a common alternative, especially in North America|
আগেই বলেছি, আমি কাউকে ছোট করছি না কিংবা দোষ দিচ্ছিনা। কেননা, আমাদের দেশে জনসংখ্যা ১৭ কোটির উপরে, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে প্রান্তিক চাষী ও নিরন্ন পরিবারের সংখ্যাও। গোটা জনসংখ্যার বৃহদাংশ এখনো অপুষ্টিতে এবং সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি, কারিগরি শিক্ষা, দক্ষ জনশক্তি ইত্যাদির অভাব। এই সব কিছুকে নিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে তারেক রহমানের নতুন পরিকল্পনা। যেমন আমাদের শিক্ষানীতি কেমন হবে, আমাদের স্বাস্থ্য নীতি কেমন হবে, আধুনিক প্রযুক্তি রপ্তের কৌশল কি হবে- এসব ক্ষেত্রে বিশেষায়িত বিশেষজ্ঞ, এই ফিল্ডে ইতিপূর্বে যার ট্র্যাক রেকর্ড ভালো রয়েছে এবং সফলতার মাত্রা ভালো, এগুলো বিবেচনা করেই বিশেষজ্ঞ বা উপদেষ্টা নিয়োগ করা উচিত, যাতে সেই বিশেষজ্ঞের লব্ধ জ্ঞান দলীয় কৌশল অনুযায়ী পলিসি তৈরি করে বাস্তবায়ন করা যায়, তাতে নেতা যেমন হন উপকৃত, সম্মানিত ও জনপ্রিয় হন, তেমনি দেশ এবং দলও হন উপকৃত।
এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়, বিগত বিশ্ব মন্দার সময়ে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে ধ্বস নেমে আসে। ব্রিটেনে যারা আছেন তারা অবশ্যই স্বীকার করবেন, এর প্রভাব কি পরিমাণ পড়েছিলো। ওই সময়ে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নরের মেয়াদ শেষ হলে ব্রিটেন তাদের ৩০০ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে কানাডার ব্যাংকিং প্রফেশনাল মার্ক কার্নি যার ট্র্যাক রেকর্ড আকাশ ছোঁয়া তাকে হায়ার করে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর করে। তার মানে কি সারা ব্রিটেনে মার্ক কার্নির মতো একজনও ব্যাংকিং এক্সপার্ট ছিলো না ? নিশ্চয়ই ছিলো। এমনকি মার্ক কার্নির চাইতে আরো উচ্চ ডিগ্রিধারীও ছিলো। কিন্তু ব্রিটেন দেখেছে ব্যাংকিং সেক্টরে ও বিশ্ব অর্থনীতির ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে সব চাইতে কাজের সফল রেকর্ড কার রয়েছে, সেদিকটা ওরা বিবেচনায় নিয়ে কানাডা থেকে হায়ার করে নিয়ে এসে তাকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর করেছে।
আর মার্ক কার্নি ইংল্যান্ডের গভর্নর হয়ে কাজে মনোযোগী হন, অর্থনীতির কৃচ্ছ্র সাধনের সাথে সাথে আর্থিক ক্ষেত্রে ঝুঁকি সমূহ কাটিয়ে উঠার ধীরে ধীরে ব্যবস্থা করে ব্রিটিশ অর্থনীতিকে ট্র্যাক লাইনে নিয়ে আসেন, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সেজন্যে তাকে কাজ করতে হয়েছে এবং হচ্ছে, সেলফি নিউজের দিকে মনোনিবেশ করেন নি।
আমার পয়েন্টটা এখানেই। ভাবী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়ে ভাবী প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক পলিসি, কৌশলে কোনরূপ পরিবর্তন বা নতুনত্ব না এনে কেবল বাংলা মিডিয়ার নিউজ, আর ফেসবুকের প্রচারে ব্যস্ত তারেক রহমানের কল্যাণমূলক শ্যাডো কেবিনেট নেগেটিভ অবস্থার জন্ম দিবেনা তো? ভয় এখানেই।
এখানে আরেকটি বিষয় খুবই প্রণিধানযোগ্য আর তা হলো- শহীদ জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর বিএনপিকে ৯১ তে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলো দেশের তরুণ ও ছাত্র সমাজ। তারেক রহমানের পেছনে এখনো সেই ছাত্র ও তরুণ সমাজ আছেন। দরকার শুধু সঠিক দিক নির্দেশনা। শ্যাডো কেবিনেট রাজনীতিতে অবশ্যই একটা ভালো উদ্যোগ এবং নতুন। সঠিকভাবে প্রণীত হলে এর দ্বারা দল এবং দেশ উপকৃত হবে সন্দেহ নেই। এমনকি এভাবে সারা বাংলাদেশে কমিটিগুলোকেও একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা যাবে, উপদল সৃষ্টিও বন্ধ করা যাবে।
তবে এই শ্যাডো কেবিনেটকে তারেক রহমান একটি সেক্রেটারিয়েটের অধীনে আনতে পারেন যেন পুরো কেবিনেট তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। এতে সারাদেশে একটি চেইন অব কমান্ড স্থাপিত হবে এবং এর অধীনে সকল কর্মসূচী, সিদ্ধান্ত, প্রেস, রাজনৈতিক বক্তব্য, প্রকাশনী ইত্যাদি প্রচারিত হবে। তা নাহলে এই মিনি কেবিনেট-তারেক রহমানের নামে সারা বাংলাদেশের দলীয় লোকজনের কাছে মনে হবে এরাই শুধু তারেক রহমানের কাছের লোক এবং এই কাছের লোকগুলোই তারেক রহমানের নামে আতংক তৈরি করবে। এমনটা আশংকার কারণ, আমরা বাঙালি, আমাদের স্বভাব তাই, মননে মগজে এমন যে ভালো কিছু নিজেদের দোষে মন্দ হয়ে যায়। সার্বিক পরিস্থিতি তাই করে তুলবে। সেজন্যেই জোর দিয়ে বলছি, যাতে কেউ সেই চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘন না করে তারেক রহমানের উপদেষ্টা কিংবা তারেক রহমানের কাছের লোক বা তারেক গ্রুপ অথবা সেলফি কোন প্রচারণার দ্বারা নিজেদের ফায়দা করতে ও সাধারণ দলীয় কর্মী কিংবা নেতা বা সরকারি প্রশাসনে কোন দ্বিতীয় লবি সৃষ্টি করতে না পারেন। কেননা উপদেষ্টা নিয়োগ এখানেই শেষ নয়, আরো অনেকেই নিয়োগ পাবেন। সেজন্যে পুরো কেবিনেটকে একটি মাত্র চেইন অব কমান্ডের অধীনে নিয়ে আসতে হবে এবং প্রত্যেকের কাজের জবাবদিহিও রুটিন মাফিক সেই সেক্রেটারিয়েটকে অবহিত করার বাধ্যবাধকতায় নিয়ে আসতে হবে। একই সাথে তারেক রহমানের পরিচিতি ব্যবহার করে দলীয় সিদ্ধান্তের ও সেক্রেটারিয়েটের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বক্তব্য দেয়া যাবে না। তবেই হয়তো আমরা সেই মিনি কেবিনেট থেকে ফায়দা পেতে পারি।