বিদেশি আশ্বাসের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে!
২০ দল থেকে বেরিয়ে আসা শেখ শওকত হোসেন নীলু এক আলোচনায় বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানদেরকে যে কোনো সময় ঈঙ্গিত দেবেন, যাতে তারা সরকারকে সহযোগিতা না করে। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে এবং বিএনপি ক্ষমতাসীন হবে। তার মতে, বিএনপি নেতারা এমন সম্ভাবনার ওপর ভর করে বসে আছে।
নীলুর এমন তথ্যের যদিও কোনো ভিত্তি নেই, তবে বিএনপি নেতারা বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া কোনো না কোনো একটি আশ্বাসের ওপর ভর করে যে বসে আছেন, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। অবশ্য, সেই আশ্বাসটি কোথাকার এবং কীসের এটিই হলো বড়ো প্রশ্ন। ঘনিষ্ঠরা এমন আভাস দিচ্ছেন যে, বেগম খালেদা জিয়া এ মুহূর্তে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে আশ্বাস পেয়েছেন। আর এ কারণেই আন্দোলনের মাঠে নামার পরিকল্পনা থেকে আপাতত বিরত আছেন।
গত রমজানের সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রায় প্রতিদিনই বলছিলেন, ঈদের পর আন্দোলন শুরু হবে। এমন আন্দোলন হবে যে, সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাহস পাবে না সামনে দাঁড়ানোর। কিন্তু, সেই আন্দোলন আর শুরু হলো না। রমজানের ঈদের পর ছোটখাটো দু’একটা কর্মসূচি পালনের পর হঠাৎ থেমে গেলেন ২০ দল নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কর্মসূচিগুলো শান্তিপূর্ণ এবং জনসমাগমও বেশ হচ্ছিলো। তারপরও বেগম খালেদা জিয়া থেমে গেলেন, রাস্তায় দ্রুতবেগের গাড়ি যেভাবে হঠাৎ ব্রেক করে ঠিক তেমনি।
এর পরপরই আলোচনায় এলো নির্বাচন। বিএনপি নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে সরকারের মধ্যবর্তী নির্বাচনের গোপন প্রস্তুতি ও ষড়যন্ত্রের কথা বলতে লাগলেন। বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্রের আশংকাও তারা করতে লাগলেন। পাশাপাশি দেখা গেলো ২০ দল থেকে শেখ শওকত হোসেন নীলুর মতো ঠিকানাবিহীন কিছু দলের নেতাকে বেরিয়ে যেতে এবং বিএনপি-জামায়াতের বাইরে নতুন করে জোট গঠনের প্রস্তুতি নিতে। ফলে সব মিলিয়ে রাজনীতিতে বেশ জোরেশোরেই আলোচনায় স্থান পেলো নির্বাচন। কিন্তু না, কয়েক দিনের মাথায়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সম্মেলন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা সরাসরি নাকচ করে দিলেন। তা থেকে নির্বাচনের কানাঘুষা থেমে গেলো।
ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে, যেহেতু নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে ভেতরে ভেতরে তাই আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেটিরও যেহেতু সম্ভাবনা সরকার নাকচ করে দিয়েছে তারপরও আন্দোলন কেন থেমে আছে- এ প্রশ্ন অনেকেরই। কেউ বলছেন, আন্দোলন করার মতো শক্তি বিএনপি এখনো অর্জন করতে পারেনি। আবার কেউবা বলছেন, জামায়াত সরকারের সঙ্গে চলে যাওয়ায় বিএনপি এগোনোর সাহস পাচ্ছে না। এও বলা হচ্ছে- ‘কঠোর হস্তে আন্দোলন দমন’র সরকারি পাল্টা হুমকিতে বিরোধীদল ভয় পেয়েছে। আবার কেউবা আওয়ামী লীগ সরকার হটাও আন্দোলনের সম্ভাবনা একেবারেই নাকচ করে দিচ্ছেন। বলছেন, আগামী ৫ বছরেও সরকারের কিছুই করতে পারবে না বিএনপি। তবে কেউ কেউ এমন আশাবাদী, সরকারকে বেগম খালেদা জিয়া সময় দিচ্ছেন যাতে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়। শিগগিরই আন্দোলন শুরু হবে এবং সেই আন্দোলনে অতি কম সময়েই সরকারের পতন ঘটবে।
বিএনপি কার্যকর কোনো আন্দোলন শুরু করতে পারবে কিনা, তাতে ফলাফল কী দাঁড়াবে- এটা মূল্যায়ন করার সময় এখনো আসেনি। তবে বাংলাদেশের ক্ষমতার পট পরিবর্তন যে শুধু আন্দোলন দিয়ে হয় না, এটা সবাই বোঝেন। এরসঙ্গে অনেক সমীকরণ কাজ করে। সেই সমীকরণের জন্য অপেক্ষা করছেন কী বেগম খালেদা জিয়া, এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় প্রশ্ন।
এডভোকেট কামরুলের টিটকিরি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর জামালপুর জেলা স্কুল মাঠে আয়োজিত সমাবেশে দেশবাসীকে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ঈদটা যাক, ঢাকায় গিয়ে কর্মসূচি দেবো। হাসিনাকে বিদায় করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবো।
খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের রেশ ধরে শিল্পকলা একাডেমিতে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত এক আলোচনা সভায় খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, বার বার ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। আসলে বুঝতে পারছি না তারা কোন ঈদের পর আন্দোলনে নামবেন। আমাদের শরীরে জং ধরে গেছে। আমরা চাই, তারা আন্দোলনে নামুক। তাহলে আমাদের শরীরের ব্যায়াম হবে।
ছাত্রদলের কমিটি ও ৯০-এর ডাকসু
বলা যায়, গত সপ্তায় গোটা রাজনীতিতে আলোচনার একটি অন্যতম বিষয় ছিলো ছাত্রদলের নতুন কমিটি। ছাত্রদলে নতুন কমিটি ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছিলো বেশ আগে থেকেই। কিন্তু, কেন যেন বার বার পিছিয়ে যাচ্ছিলো। বিএনপি নেতৃত্ব এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভূগছিলেন। কেন এ সিদ্ধান্তহীনতা তা নিয়ে অনেকে কানাঘুষাও করছিলেন। নতুন কমিটিতে কোন পদে কে থাকছেন, সম্ভাব্য নামও আলোচনায় আসছিলো বেশ নিশ্চিতভাবে।
কিন্তু না, অবশেষে এমন কমিটির ঘোষণা দেওয়া হলো যা নিয়ে তুমূল বিতর্ক দেখা দিলো। শুধু বিতর্কই নয়- বিএনপি অফিস ঘেরাও, বিক্ষোভ সমাবেশ, লাঠি হাতে জঙ্গি মিছিল, বোমাবাজি, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় অফিসে তালা প্রভৃতি চলতে থাকলো। এমন পরিস্থিতি দেখা দিলো তাতে মনে হলো, ছাত্রদল যেন হঠাৎ কোথা থেকে বড় ধরনের শক্তি পেয়ে গেছে। যে ছাত্রদলকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে-ময়দানে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হতো সেই ছাত্রদল হঠাৎ এতো শক্তিমান হয়ে উঠলো! সবাই আশ্চর্যই হলেন। কেউ কেউ বলতে লাগলেন, এটা একটা সুখকর সংবাদই বটে- ছাত্রদল এখন ৯০’র মতো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বস্তুতই ছাত্রদল এক সময় অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিলো। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার এই সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। বরং ’৮৬ সালের আঁতাতের নির্বাচন বয়কটের পর থেকে বেগম খালেদা জিয়া তরুণ সমাজের কাছে ‘আপোষহীন’ নেত্রীরূপে আবির্ভূত হলেন। এই সময় ছাত্রদলের শক্তি দ্রুতই বাড়তে থাকে। ’৮৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে অন্য সব ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’র ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী দেয়। তাতে যদিও ছাত্রদল হেরে যায়, বলা হয় এটা ছিলো ভোট জালিয়াতি ও চক্রান্তের নির্বাচন, জোর করে ছাত্রদলকে হারানো হয়েছে। পরের বছর নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর প্রাক্কালে ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষিত হয় ‘দুদু-রিপন’।
ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পর পর দুই দিন এই প্যানেলের পক্ষে বড় বড় মিছিল-সমাবেশ করে। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যেও ছাত্রদলের পক্ষে এক ধরনের জোয়ার লক্ষ্য করা যায়। সবাই বলাবলি করছিলো, এবার ছাত্রদলকে আর ঠেকানো যাবে না।
দিন দুয়েক পরে হঠাৎ একদিন সকালে পত্রিকায় দেখা গেলো, ছাত্রদলের প্যানেল ‘দুদু-রিপন’ নয়, ‘আমান-খোকন’। ‘আমান-খোকন’ প্যানেলই ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্রতিনিধিত্ব করবে। বিএনপি নেতৃত্বেরই এ সিদ্ধান্ত এবং এটা পরিবর্তন হবে না। ছাত্রদলের নেতা-কর্মী, এমনকি বিএনপি-ছাত্রদলের শুভাকাঙ্ক্ষীরাও যারা ডাকসু নির্বাচন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো এদের মাথায় বাজ পড়লো যেন। সবাই বলছিলো, নিশ্চিত জয় এখন অনিশ্চিত হয়ে গেলো। কেউ কেউ এও বলতে ছাড়ছিলো না যে, এটা এরশাদ সরকারের একটা গোপন চক্রান্ত। কারণ, এরশাদের প্রধান শত্রু ছিলো ছাত্রদল।
এদিন ভোরে মধুর ক্যান্টিনের সামনে ছাত্রদলের নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ক্রমান্বয়ে জড়ো হয়ে হা-হুতাশ করতে লাগলো। কাউকে কাউকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে গালাগাল এবং হতাশায় কাঁদতেও দেখা গেলো। এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়লো, প্যানেল পরিবর্তনের জন্য আবদুল মতিন চৌধুরী এবং জাহানারা বেগম দায়ী। মতিন চৌধুরীর বাসায় গভীর রাতে নাকি ‘আমান-খোকন-আলম’ প্যানেলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগলো সবাই। নতুন প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আমান উল্লাহ আমান ক্যাম্পাসে পা দেওয়ার পর পরই তাকে নাজেহাল এমনকি টেনেহিঁচড়ে জামাকাপড় ছেঁড়া হলো। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাই এটা করেছে।
বস্তুত, ছাত্রদলের নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ওই সময় ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিলো। কারণ, আমান ওই সময় কোনো ক্রমেই ছাত্রদলের মতো সংগঠনের ভিপি প্রার্থী হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। তিনি ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ নন। আসলে ছাত্রদলে যে এই নামে কোনো নেতা আছে এটাও ক্যাম্পাসের অনেকে জানতেন না। খায়রুল কবির খোকনের কিছুটা পরিচিতি ছিলো। তবে ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী হিসেবে তাকে কেউ ভাবতে পারেননি। অন্যদিকে নাজিম উদ্দিন আলম তো অনেকটা আমানের মতোই। কেউ কেউ এই প্রথম ছাত্রদলের এ নেতার নাম জানলেন। এমন আনকোরা ধরনের নেতাদের নিয়ে ডাকসু নির্বাচনে লড়াই করাটা সত্যিই একটা বড় অস্বাভাবিক ঘটনা ছিলো। কেন বিএনপি নেতৃত্ব ওই সময় এমন একটা অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ওই সিদ্ধান্তে অটল থাকছিলেন কারো মাথায় এর উত্তর আসছিলো না।
তবে, এই সিদ্ধান্তের পক্ষে এমন একটা ক্ষীণ যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছিলো, ‘দুদু-রিপন’ প্যানেল সানাউল হক নীরু কর্তৃক ঘোষিত হয়েছিলো এবং এ প্যানেল ঘোষণার আগে বেগম জিয়ার সঙ্গে কোনোরকমের আলোচনা পর্যন্ত করা হয়নি। নীরুসহ এই গ্রুপটি এরশাদ সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাতে লিপ্ত রয়েছে এবং আঁতাতের অংশ হিসেবেই ‘দুদু-রিপন’ প্যানেল ঘোষিত হয়েছে। আর এ কারণেই বেগম খালেদা জিয়া পুরো গ্রুপটিকে বাইপাস করে সম্পূর্ণ আনকোরা ধরনের নেতাদের সমন্বয়ে প্যানেল ঘোষণা করেছেন।
যদিও ওই সময় এ যুক্তিগুলো কেউ গ্রহণ করতে চাননি পরবর্তীতে রাজপথের আন্দোলনের সময় তা-ই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছিলো। ’৯০ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের সেই আনকোরা নেতারাই পুরো প্যানেলে জয়ী হয়েছে। এর চার মাসের মাথায় নভেম্বর-ডিসেম্বরে সেই ডাকসু নেতারাই এরশাদ পতনের আন্দোলনে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’র ব্যানারে নেতৃত্ব দেয়। অন্যদিকে নীরু-অভির নেতৃত্বে সশস্ত্র সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনী এরশাদকে রক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
অবশ্য, এখন এটি নিছক একটি ইতিহাস মাত্র। কিন্তু, ছাত্রদলের এই নতুন কমিটি গঠন এবং এর আগে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে যে লঙ্কাকা- ঘটে গেছে তা পেছনের সেই ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল ঘোষণার ইতিহাসকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে বার বার।
হতে পারে এটি বর্তমান নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্ত। সবার কাছে পরিচিত ও যোগ্য নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে যা কেউ কল্পনাও করেনি। এর জের হিসেবে খবরের পাতায় এসেছে মুখরোচক প্রতিবেদন, আর ছাত্রদল কর্মীদের ক্ষেপিয়ে তোলার সুযোগকে কেউ কেউ কাজে লাগিয়েছে।
তবে এটা কেউ অস্বীকার করবেন না, বিএনপি এখন খুব খারাপ সময় পার করছে। বলা যায়, ৯০-এর সেই সময়গুলোর তুলনায়ও খারাপ। এই সময় বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আস্থা-অনাস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তাই এ মুহূর্তে যোগ্যতা-অযোগ্যতার চেয়ে বেগম খালেদা জিয়া আস্থা-অনাস্থাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র একজন বিএনপি নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, গত ৫ জানুয়ারির পূর্ব মুহূর্তগুলোতে খালেদা জিয়া নিজেই পরখ করতে পেরেছেন, আন্দোলনের জন্য কে কতটা যোগ্য। তিনি বলেন, চেহারা দেখে নেতা বানানোর দিন শেষ হয়ে গেছে। আন্দোলনের মাঠে কে কতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে পারবে সেটাই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বেশি বিবেচনায় আনা হয়েছে।
জামায়াত-বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক
বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সম্পর্ক কতটা আছে, এটা রাজনীতির আলোচনায় স্থান পাচ্ছে বেশ গুরুত্ব সহকারে। বিশেষ করে সরকার সমর্থকরা বলছেন, জামায়াত বর্তমানে বিএনপি’র কব্জায় নেই। আন্দোলন-সংগ্রামে জামায়াত এখন আর আগের মতো সিরিয়াসলি মাঠে নামবে না। কারণ, ইতিমধ্যে এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের একটা বিশেষ সমঝোতা হয়েছে।
কিন্তু, বিএনপি এমন সমীকরণ মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য হলো, আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা হলে জামায়াত তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে এবং সর্বশক্তি নিয়েই মাঠে নামবে। এখন কৌশলগত কারণে জামায়াত একটু আলাদা অবস্থানে রয়েছে এবং এটা হয়েছে উভয় দলের নীতিনির্ধারকদের সম্মতিতেই। অবশ্য, জামায়াতও সরকারের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য কোনো আঁতাত বা সমঝোতা হওয়ার কথা অস্বীকার করছে। এমনকি এ ধরনের আঁতাত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভবিষ্যতেও কখনো হওয়া সম্ভব নয়, একথা নিশ্চিত করে বলছেন জামায়াত নেতারা।
বিদেশি আশ্বাসের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে
বিএনপি’র একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিদেশি একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্বাসের কারণে বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনে নামতে গিয়েও থেমে আছেন। ইতিপূর্বে তিনি শুধুমাত্র মার্কিনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পরামর্শ শুনছিলেন। অতি সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে এই মর্মে আশ্বাস পেয়েছেন, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা এবং এর ধারাবাহিকতায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা তারা করবেন।
যতোটা জানা গেছে, ভারতের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু, কোনোরকমের আলোচনায় যাওয়ার অর্থ এই দাঁড়ায়, বিএনপিকে ক্ষমতাসীন করা। অথচ আওয়ামী লীগ কোনো ক্রমেই বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে রাজি নয়। তাই এ মুহূর্তে ভারতের কথাও তারা শুনছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রমতে, সম্প্রতি মধ্যবর্তী নির্বাচনের যে উদ্যোগের কথা শোনা গিয়েছিলো সেটি একেবারে মিথ্যে ছিলো না। সরকারি মহল বিশেষ একটি পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা মেনে নিয়েছিলো। তারা মনে করেছিলো, বিএনপিকে ভেঙে তছনছ করা যাবে। বিএনপির বিকল্প হিসেবে পাল্টা দল গঠন করে আবারো একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে চেয়েছিলো তারা। বিশ্বকে বোকা বানানোর উদ্দেশ্যেই এটি করতে চেয়েছিলো। এ কারণেই ২০ দলীয় জোটের মধ্যকার নামসর্বস্ব দলগুলোর কয়েকজন নেতাকে হাত করা হয়েছিলো। কিন্তু, অবশেষে মূল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
এর কারণ হলো, মূল স্রোতের বাইরে যেতে কেউ রাজি নন। দলে বিদ্রোহের ফলাফল ভালো হয় না, এটা সবাই ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন। ইতিপূর্বে অনেক বাঘা বাঘা নেতারাও এমন কিছু করতে গিয়ে চরমভাবে ধরা খেয়েছেন। নিজেদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে গেছে। এর অসংখ্য নজির অতীতে রয়েছে।
বস্তুত, এমন ছক ব্যর্থ হবার পরই মধ্যবর্তী নির্বাচনের পথ থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দ্রুত বেরিয়ে আসে। আপাতত ‘আলোচনা’ বা ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’র বিষয়গুলো আওয়ামী লীগ তাদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। এসব ইস্যুতে কারো পরামর্শই তারা শুনবে না। এমনকি ভারতের পরামর্শও নয়।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিএনপি নেতৃত্ব অনেকটাই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলো এ কারণেই যে, ভারত যেহেতু উদ্যোগ নিচ্ছে এ থেকে একটা ভালো ফল অবশ্যই পাওয়া যাবে। আর তাই বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতারা বার বার আত্মবিশ্বাসের সূরে বলছিলেন, বিএনপি’র সঙ্গে আলোচনায় অবশ্যই আসতে হবে। যদু-মধুর সঙ্গে আলোচনা করে লাভ হবে না। তাদের বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ সরকারকে অবশ্যই ভারতের কথা মানতে হবে। এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই বিএনপি চেয়ারপারসন আন্দোলনের ক্যালেন্ডার বার বার পেছাচ্ছেন।
তবে এই সময়ও পার হতে চললো। আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তারা হতে দেবে না। এরজন্য যা কিছু দরকার সবই করা হবে। যে কোনো কিছুর মূল্যে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকানো হবে। এ সিদ্ধান্তের বাইরে তারা কারো কথা শুনতে রাজি নয়- ভারত বা অন্য কোনো দেশ।
এদিকে বিদেশি আশ্বাসের ওপর ভর করে অনির্দিষ্টকাল বিএনপির বসে থাকা সম্ভব নয়। আর এ কারণেই বিএনপি নেত্রীকে অবশেষে আন্দোলনের ছক নতুন করে আঁকতে হচ্ছে। যতোটা জানা গেছে, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসকে এই নতুন টার্গেট হিসেবে ধরা হয়েছে।