সপ্তাহে আটক ৫৫; সুন্দরবন উপকূলে ভারতীয় জেলেদের উৎপাত
শীত মৌসুম শুরু না হতেই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন জলসীমায় বিদেশি (বিশেষ করে ভারতীয়) জেলেদের উৎপাত শুরু হয়েছে। এ কারণে অসহায় হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের জেলেরা। অনেক সময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশি জেলেদের ট্রলারে হামলা চালায়। জেলেদের মারধর করে লুটপাট চালানো অভিযোগও রয়েছে।
চলতি শীত মৌসুমের শুরুতেই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের অপরাধে চারটি ফিসিং ট্রলারসহ ৫৫ ভারতীয় জেলেকে আটক করেছে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর সদস্যরা।
স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, ভারতীয় জেলেদের উৎপাতে দেশি জেলেদের মাছ শিকার ব্যাহত হচ্ছে। প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশি জেলেরা বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় নানা ধরনের মাছ আহরণ করেন। এ সময়টা জেলেদের মাছ আহরণের উপযুক্ত মৌসুম। সাগর এ সময় অনেকটা শান্ত থাকে।
জেলেরা অভিযোগ করে বলেন, এই সময় বিদেশি ট্রলার বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ে মাছ শিকার করে। পার্শ্ববর্তী ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে জেলেরা অবৈধভাবে বড় বড় অত্যাধুনিক ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে। অধিকাংশ সময়ই তারা গোপনে মাছ শিকার করে চলে যায়। বিদেশি জেলেরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার ব্যবহার করে। এ সময় তাদের ট্রলারে বসে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তৎপরতায় চোখ পড়লে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়।
সুন্দরবন উপকূলের জেলেপল্লী দুবলারচরের মেহের আলীর টেকের জেলেদের মহাজন চট্টগ্রামের শুক্কুর, অনিল বরণ দাস, শুঁটকি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ, মাছধরা টট্রলার এফবি মানিকের সারেং রায়মোহন মাঝি এবং জেলে উজ্জ্বল কান্তি এমন অভিযোগ করেন।
তারা জানান, ভারতীয়রা বাংলাদেশি জেলেদের বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিয়ে মাছ ধরতে বাধা দেয়। কখনও কখনও ভারতীয়রা বাংলাদেশি জেলেদের ট্রলার ও নৌকায় হামলা চালায় এবং লুটপাট করে। বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলীয় দুবলারচর সংলগ্ন শ্যালারচর, ছাপড়াখালী, আলোরকোল, মাঝের কিল্লা, অফিস কিল্লা এবং নারকেল বাড়িয়ার জেলেপল্লীর আলী হোসেন, জাহাঙ্গীর মাঝি, খালেক মাঝি, বাবুল মাঝি ও লোকমান মাঝিসহ অনেকেই এ ধরনের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন।
তারা আরো জানান, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে ভারতের কাকদ্বীপ এলাকা কাছে হওয়ায় সেখানকার বিপুলসংখ্যক জেলে এ দেশের জলসীমায় মাছ ধরতে আসে। মাছ ধরার অত্যাধুনিক জালসহ আধুনিক বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকায় তারা অনেক বেশি মাছ আহরণ করতে পারে। বাংলাদেশের জলসীমায় যে এলাকায় মাছের পরিমাণ বেশি, সাধারণত সেই এলাকায় তারা মাছ শিকার করে। তাদের অপতৎপরতায় বাংলাদেশি জেলেরা ওইসব এলাকায় মাছ শিকার করতে পারেন না।
সাগরে অধিকাংশ সময়ই ভারতীয় জেলেদের উৎপাত বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন মংলার মৎস্য ব্যবসায়ী শেখ কামরুজ্জামান জসিম। সাগরে মাছ ধরার জেলেদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ পাঁচ ধরনের অত্যাধুনিক জাল ব্যবহার করে। পাশাপাশি মাছের পোনাও ধরে। তাদের কাছে রয়েছে জিপিএস (বিশেষ সংকেত) নামক বিশেষ ধরনের যন্ত্র। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় জেলেরা যে পথ দিয়ে সাগরে আসে, আবার সে পথ দিয়েই ফিরে যায়।
সুন্দরবনের মৎস্যজীবী জাবেদ হোসেন জানান, বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় ফিশিং ট্রলার দেশীয় সমুদ্রসীমার প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করে মাছ ধরছে। বাংলাদেশের জেলেরা সেখানে গেলে তারা হামলা চালাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন উপকূলের মৎস্যজীবীদের সংগঠন দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রায় সব সময়ই বিদেশিরা দেশীয় জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরে। ফলে আমাদের সমুদ্রসম্পদ আহরণ কমে যাচ্ছে।
পুলিশ জানায়, মংলা বন্দর থেকে প্রায় ১৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে এলাকায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকার করছে। এ অভিযোগে ওই এলাকায় টহলরত নৌ-বাহিনীর সদস্যরা গত এক সপ্তাহে চারটি ট্রলারসহ ৫৫ ভারতীয় জেলেকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
মংলা থানার ওসি বেলায়েত হোসেন জানান, এদেশে ধরা পড়া ভারতীয় জেলেদের বিরুদ্ধে সাধারণত অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও মাছ চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়।
আদালতের একটি সূত্র জানায়, ধরা পড়া বিদেশি জেলেরা আদালতে সাধারণত বঙ্গোপসাগরে সীমারেখা বুঝতে না পেরে ভুল করে প্রবেশ করার দাবি জানিয়ে অল্প দিনের মধ্যে কারাভোগ করে মুক্তি পেয়ে যায়।
তবে দেশীয় জেলেরা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ জলসীমায় বেশি মাছ পাওয়া যায় তাই ভারতীয় জেলেরা বেশি মাছের আশায় ইচ্ছে করেই এ বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করছে। আর লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ।