মাদকে আর কত প্রাণ যাবে?
মাদকের ভয়াল থাবায় তছনছ হয়ে গেছে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার নীলটেক গ্রামের একটি পরিবার। সম্প্রতি ওই পরিবারে মাদকাসক্ত এক ছেলের হাতে খুন হয়েছেন বাবা মহিউদ্দিন প্রামাণিক (৬৫) ও মা সুফিয়া বেগম (৫৫)। পরে পুলিশের গুলি আর গণপিটুনিতে নিহত হন ছেলে সাঈদুর রহমান প্রামাণিক (৩৫)।
স্থানীয় লোকজন জানান, পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে একসময় শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেছিলেন সাঈদুর রহমান। বিয়ে করে ঘরও বেঁধেছিলেন। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে মাদকের থাবায় তাঁর স্বাভাবিক জীবন পাল্টে যায়। মাদকের প্রভাবে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। যার করুণ পরিণতি হয় ১৯ অক্টোবর বাবা-মাকে হত্যার পর তাঁর নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
এর আগে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি একই উপজেলার বায়রা গ্রামে মাদক কেনার টাকা চেয়ে না পেয়ে তাঁর স্ত্রী নার্গিস আক্তারকে (২৬) কুপিয়ে হত্যা করেন মুকুল হোসেন (৩৫) নামের মাদকাসক্ত এক ব্যক্তি। এ সময় নার্গিসকে বাঁচাতে এগিয়ে এসে তাঁর চাচাতো বোন সাথী আক্তারও (৩০) খুন হন।
মাদকের কারণেই গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে ছেলের হাতে খুন হয়েছেন ঢাকার আশুলিয়ার পলাশবাড়ির ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন (৪০)।
মাদক কেনার টাকা না পেয়ে ছেলে আকাশ (১৭) তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় গলা কেটে হত্যা করেন।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এভাবে এ এলাকায় মাদকের জন্য একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর পরও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদকের বিস্তার রোধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনুপম দাস বলেন, অধিক পরিমাণে মাদক গ্রহণের ফলে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হয়। এর প্রভাবে মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করেন। কোনো বাধা পেলেই তাঁদের ভেতরে তাৎক্ষণিক ক্রোধ জন্ম নেয়। এ ক্রোধ থেকেই তাঁরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটান।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট থানাগুলোর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদকের প্রভাবে ঢাকার সাভার, আশুলিয়াসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতাসহ অসচেতনতার কারণে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
থানা-পুলিশের তথ্য, মামলার অভিযোগ ও লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদককে কেন্দ্র করে ঢাকার সাভার ও মানিকগঞ্জে গত দুই বছরে ২১টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাভার উপজেলায় ১৩টি এবং মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় ছয়টি, সদর উপজেলা ও শিবালয়ে একটি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মাদক কেনার টাকা চেয়ে ব্যর্থ হয়ে ও মাদকের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সিঙ্গাইরের নীলটেক গ্রামের নিহত মহিউদ্দিন প্রামাণিকের মেয়ে খালেদা বেগম বলেন, ‘অনেক চেষ্টা কইরাও আমার ভাইরে মাদক ছাড়াইবার পারি নাই। শেষ পর্যন্ত এই মাদকের জন্য ও তো মরলই, বাবা-মাকেও মারল। আমাদের পরিবারটাই ধ্বংস হইয়া গেল মাদকের কারণে।’
সাভার পৌরসভার বাঁশপট্টি এলাকার কোরবান আলীর ছেলে ইজ্জত আলী বলেন, লিটন ও শাজাহান নামের দুজন তাঁর ছোট ভাই ভাসানের বন্ধু ছিলেন। ওই বন্ধুদের কারণেই ভাসান একসময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। পরে মাদকের টাকা জোগাড় করতে তাঁরা জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। ওই ব্যবসার টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়েই বন্ধুদের হাতে গত বছরের ১০ অক্টোবর ভাই খুন হন।
পোড়াবাড়ী সমাজকল্যাণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক রমজান আহাম্মেদ বলেন, মাদকের সহজলভ্যতার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা উপ-অঞ্চলের পরিদর্শক শাহরিয়ার শারমিন বলেন, মাদকের ভয়াবহতা কমিয়ে আনতে ধরপাকড় ও মামলার পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জনসাধারণকে সচেতন করতে পারলে সমাজে এর প্রভাব কমে আসবে।
মানিকগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তবে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল করতে পুলিশের পাশাপাশি জনসাধারণের সচেতনতাও বাড়ানো প্রয়োজন।