জামায়াতের টাকার জোগানদাতা
একাত্তরে আলবদর বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক, চট্টগ্রাম গণহত্যার নায়ক এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম আলী পরিচিত মূলত জামায়াতে ইসলামীর অর্থের জোগানদাতা হিসেবে। জামায়াতে ইসলামীকে শক্ত আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে কাজ করে চলেছেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করলে হাজার হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছে, মসজিদ-মাদ্রাসা ভেঙে ফেলা হয়েছে ইত্যাদি তথ্য দিয়ে সৌদি সরকার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এনেছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এরপর শুধু সৌদি সরকার নয়, বিভিন্ন ইসলামি দেশ বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর মাধ্যমে অর্থ পাঠায় বাংলাদেশে—যার মূল মধ্যস্থতাকারী মীর কাসেম আলী।
তবে ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে মীর কাসেমের প্রাতিষ্ঠানিক উত্থান হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) গঠনের মাধ্যমে। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। ব্যাংক গঠনের পর চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম ও শিক্ষা—সব খাতেই বিচরণ তাঁর এবং এতে সব সরকার থেকেই পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন তিনি।
জানতে চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘মীর কাসেম জামায়াতের অর্থের জোগানদাতা। সৌদি সরকারের কাছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আনেন। এর পর সব আমলেই পৃষ্ঠপোষকতা পান। ২০১০ সালেও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) মর্যাদা দিয়ে তাঁকে বিদেশে যেতে দিয়েছে সরকার।’
গতকাল বৃহস্পতিবার যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো) থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব খাতের সঙ্গে মানুষের নৈমিত্তিক সম্পর্ক রয়েছে, সেগুলোকেই বিনিয়োগের জন্য বেছে নেন মীর কাসেম। ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মীর কাসেম। অন্যতম সদস্য ইবনে সিনা ট্রাস্টের। এই ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল ইত্যাদি।
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে মামলার রায় রোববার
দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনেরও প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা মীর কাসেম। দৈনিক নয়া দিগন্ত এই করপোরেশনের পত্রিকা। এ ছাড়া ছিল দিগন্ত টিভি চ্যানেল। ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে হেফাজতে ইসলামকে নাশকতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দিগন্ত রেডিও এবং ইংরেজি দৈনিক এশিয়া পোস্ট নামে একটি পত্রিকা বের করার জন্য নিবন্ধন নিলেও শেষ পর্যন্ত চালু হয়নি। দিগন্ত পেপার মিলের পরিচালক তিনি। নামের আগে ‘কেয়ারী’ রয়েছে—এ রকম ১০টি কোম্পানির পরিচালক মীর কাসেম আলী। এগুলোতে শুধু মীর কাসেম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মালিকানা রয়েছে বলে রেজসকো সূত্রে জানা গেছে। কোম্পানিগুলো হচ্ছে কেয়ারী লিমিটেড, কেয়ারী স্প্রিং, কেয়ারী শান, কেয়ারী তাজ, কেয়ারী কালার সেন্টার, কেয়ারী ঝর্ণা, কেয়ারী পোলট্রি হ্যাচারি অ্যান্ড প্রসেস, কেয়ারী ট্যুরস অ্যান্ড সার্ভিসেস, কেয়ারী রিয়েল এস্টেট এবং কেয়ারী টেলিকম লিমিটেড। কেয়ারীর প্রধান কার্যালয় রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে কেয়ারী প্লাজায়।
কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য রয়েছে মীর কাসেমের একক মালিকানাধীন বিলাসবহুল পাঁচটি প্রমোদতরী। এগুলো হচ্ছে কেয়ারী ক্রুজ, কেয়ারী ডাইন, কেয়ারী সিন্দবাদ, কেয়ারী কর্ণফুলী ও কেয়ারী তরঙ্গ। এ ছাড়া ইডেন শিপিং লাইনসের চেয়ারম্যান তিনি। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট (এআইটি), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশনের। ১৯৮০ সাল থেকে সৌদিভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা রাবেতা আলম আল ইসলামীর দেশীয় পরিচালক তিনি এবং ইসলামী ব্যাংক স্কুল ও কলেজের অন্যতম উদ্যোক্তা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা নথিপত্র অনুসারে, ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মীর কাসেম। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মচারী তৈয়ব আলীর চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় মীর কাসেম। তাঁর ডাকনাম পিয়ারু ওরফে মিন্টু।
বাবার চাকরির সূত্রে ছোটবেলা থেকেই চট্টগ্রামে থাকতেন তিনি। ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি হন। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম শহর শাখা ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ৭ নভেম্বর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে স্বাধীন বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে। মীর কাসেম ছিলেন ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি জামায়াতের শুরা সদস্য।
নথিপত্রে আরও বলা হয়, মীর কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রামের টেলিগ্রাফ অফিসের লাগোয়া ডালিম হোটেলে রাজাকার বাহিনীর বন্দিশিবির খোলা হয়েছিল। বিজয় দিবসের এক দিন পর ১৭ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকে ৩৫০ জন বন্দীকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রণয়নকারীদের অন্যতম নায়ক ছিলেন মীর কাসেম।
১৯৮৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র প্রকাশিত একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় শীর্ষক গ্রন্থে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাসেমকে আলবদর বাহিনীর নেতৃত্বের তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
চলতি বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন আদালতের কাছে পুলিশ একটি প্রতিবেদন দাখিল করে, যাতে ৩৭৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১২৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়। মীর কাসেম আলীর প্রতিষ্ঠানগুলোও এর মধ্যে রয়েছে।
২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার দিয়েছেন। লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জামায়াতের চুক্তির কপি এবং টাকা দেওয়ার রসিদ রয়েছে সরকারের কাছে।