রোগী সুরক্ষার নামে চিকিৎসক সুরক্ষা!
আইনের নাম ‘রোগী সুরক্ষা আইন’ হলেও এ আইন দিয়ে রোগীর বদলে চিকিৎসকই বেশি সুরক্ষিত হবেন। প্রচলিত অন্যান্য আইনে অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারে পুলিশ। কিন্তু প্রস্তাবিত ‘স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন’-এ অভিযোগ ওঠার পরও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না পুলিশ। গ্রেপ্তার করলে উল্টো পুলিশকেই অপরাধী করা হবে। আইনে চিকিৎসকের অবহেলার শাস্তির চেয়ে রোগীর স্বজনদের ভাঙচুরের শাস্তি বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ রকম সব বিধান রেখে অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ দুটি আইনের খসড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে মতামতের জন্য পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এসব খসড়া পেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত রোগী সুরক্ষা আইনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তির পেশাগত ও চিকিৎসা অবহেলায় রোগীর জীবন যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তবে তাঁর বিরুদ্ধে তিন বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। আর স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইনে রোগীর স্বজন ক্ষুব্ধ হয়ে যদি হাসপাতাল বা ক্লিনিক ভাঙচুর করে, তবে তার শাস্তি তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। এসব অপরাধের জন্য উভয় ধরনের দণ্ডও দেওয়া যাবে। চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক বা অন্যদের অপরাধ আমল অযোগ্য ও জামিনযোগ্য করা হয়েছে। অথচ হাসপাতাল ভাঙচুরের অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে খসড়া আইনে ইচ্ছাকৃত অবহেলায় রোগীর স্থায়ী ক্ষতি বা মৃত্যু হলে চিকিৎসা দানকারী ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা প্রয়োগ করা হবে। দণ্ডবিধির এ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা করা যাবে।
গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. জাফরুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, “দুটি আইনই করা হয়েছে চিকিৎসকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। আসলে আইন করতে হবে গণমানুষের কথা চিন্তা করে। তাহলেই আইন যথাযথ হবে, কার্যকর করা যাবে। তা না হলে যে পরিস্থিতি চলছে, তা চলবেই। স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলার অবসান ঘটাতে হলে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হলে হাসপাতালের প্রতিটি মৃত্যুর ‘ডেথ অডিট’ করতে হবে। ডেথ অডিটের মাধ্যমেই চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। এ ছাড়া যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা চলতেই থাকবে। আর অবহেলার কারণে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হলে চিকিৎসককে গ্রেপ্তার না করার বিষয়টি সঠিক নয়। এটা কেউ মানবে না। এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্ব কিভাবে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাচ্ছে, তা আমরা দেখতে পারি।” তিনি বলেন, পুলিশের হাতে চিকিৎসককে তুলে দিতে না চাইলে বিএমডিসিকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটিকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে যদি বিএমডিসি রোগী এবং চিকিৎসককে ডেকে তদন্ত করে তাহলে জটিলতা কমবে। রোগীর আস্থা ফিরে আসবে। অন্যথায় চিকিৎসকদের পুলিশের হাতে তুলে দিতেই হবে। এই অবস্থায় রোগী, চিকিৎসক সবার স্বার্থে বিএমডিসিকে স্বাধীন করতে হবে। আর দুটি আইনেই অন্যের দায়-দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। সরকার কী করবে তা বলা নেই। সেটাও নির্ধারণ করতে হবে।
স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজউদ্দিন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোগী সুরক্ষা আইন ২০১৪’ এবং ‘স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন, ২০১৪’-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে মতামত পাওয়া গেলে তা অন্তর্ভুক্ত করে মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। সেখান থেকে যাবে সংসদে। সেখানে পাস হলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধাস্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক চিকিৎসকের চেম্বার, রোগ নির্ণয়কেন্দ্র, চিকিৎসাসর্ম্পকীয় অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান এ আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
খসড়া আইনটি নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বৈঠক করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বৈঠকে কর্মকর্তারা বলেন, প্রস্তাবিত এ আইনে রোগীর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। চিকিৎসকদের স্বার্থেই এ আইন করা হচ্ছে। এমনিতেই রোগীরা অসহায়। এ আইন হলে চিকিৎসকরা সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন। চিকিৎসকের অবহেলার শাস্তির চেয়ে রোগীর স্বজনের ভাঙচুরের শাস্তি বেশি হতে পারে না। বুঝতে হবে রোগীর স্বজনরা কখন ভাঙচুর করে। কারো অবহেলায় প্রিয়জনের মৃত্যু হলেই ভাঙচুর করে তারা। তাই অবহেলার আর্থিক ক্ষতি দুই লাখ টাকা আর স্বজনদের ভাঙচুরের শাস্তি পাঁচ লাখ টাকা হতে পারে না।
চিকিৎসকের অবহেলার শাস্তির চেয়ে ভাঙচুরের শাস্তি বেশি যৌক্তিক কি না জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, হাসপাতাল ভাঙচুরের শাস্তি অযৌক্তিকভাবেই ধরা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
খসড়া আইনে আরো বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তির প্রতি কোনো সহিংস কাজ বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ধ্বংস করলে স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অবহেলার অভিযোগ উঠলে আদালত অভিযোগ গঠনের আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে অবহেলার বিষয়ে মতামতের জন্য পাঠাবেন। এই প্যানেলের বিশেষজ্ঞরা সহযোগী অধ্যাপক বা সিনিয়র কনসালট্যান্টের মর্যাদার হবেন। স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের বিরুদ্ধে কোনো অবহেলার অভিযোগ উঠলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত না হলে সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত নিতে হবে। শুধু দণ্ডবিধিকে আমলে নিয়ে গ্রেপ্তার করা হলে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অপরাধ করেছেন বলে ধরা হবে।
খসড়ায় রোগীর প্রতি কোনো অবহেলা প্রমাণ হলে বা রোগীর ক্ষতি হলে চিকিৎসক বা অন্যদের নিবন্ধন বাতিল করার বিধান রাখা হয়েছে। নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠানের বিধি বা আইন অনুযায়ী নিবন্ধন সনদ স্থায়ী বা সাময়িকভাবে বাতিল করা হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল চিকিৎসকদের নিবন্ধন দিয়ে থাকে।
খসড়া আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) স্বীকৃত নয় এমন পদবি চিকিৎসকরা ব্যবহার করতে পারবেন না। এ বিষয়ে ডা. জাফরউল্লাহ জানান, ১০০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৯৯ জনের পদবিই বিএমডিসি স্বীকৃত নয়। এ বিধি আরোপ করা হলে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে আরো দলীয়করণ বাড়বে। যারা ক্ষমতাপন্থী তাদের ডিগ্রি দেখবে না বিএমডিসি। আর যারা বিরোধীপন্থী তাদের বেছে বেছে বিদেশি ডিগ্রি ব্যবহারের অপরাধে হয়রানি করা হবে। এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে বিএমডিসিকে আরো বিদেশি ডিগ্রির স্বীকৃতি দিতে হবে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, রোগীর অনুমতি ছাড়া তার তথ্য কোনো সংস্থা, প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যাবে না। এমনকি সন্তানসহ আত্মীয়দের কাছেও প্রকাশ করা যাবে না। তবে আদালতের আদেশে সেখানে পেশ করা যাবে। এইচআইভি-এইডসের ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীকে অবহিত করা যাবে। চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলে রোগীর মৃত্যুর সনদপত্র দেওয়া যাবে না। বিশেষায়িত বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকলে সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় নিজেকে জড়িত করা যাবে না। রোগীর ফি বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য কোনো ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভাগাভাগি করা যাবে না। অর্থাৎ ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা-পয়সা ভাগাভাগি করা যাবে না। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে কোনো মিথ্যা প্রত্যয়নপত্র বা বিল ইস্যু করা যাবে না। কোনো রোগীকেই রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, জাতীয়তা বা লিঙ্গভেদে সেবা দেওয়া থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। যে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার জন্য নিবন্ধন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যোগ্য বিবেচিত হননি, তিনি সেই চিকিৎসা দিতে পারবেন না। হত্যা, আত্মহত্যা, বিষ প্রয়োগ, অগ্নিদগ্ধ, বেআইনি গর্ভপাত, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি এসব ক্ষেত্রে পুলিশকে অবহিত করতে হবে।
আইনে সবার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া রোগীকে বিকল্প চিকিৎসা সম্পর্কে জানাতে হবে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও অস্ত্রোপচারের জটিলতা জানাতে হবে। যেকোনো নাগরিককে প্রাথমিক ও জরুরি চিকিৎসা দিতে বাধ্য থাকবে স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। রোগীকে মানসম্মত সেবা দিতে হবে। জটিল রোগের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে দেরি করা যাবে না। সব রোগের যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল, অনুুমিত রোগ, যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সিরিয়াল পাওয়ার বিষয়টিকে সুনির্দিষ্ট করা দরকার বলে মনে করেন ডা. জাফরউল্লাহ। কারণ একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সিরিয়াল পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। এ অবস্থা নিরসনের চেষ্টা আইনে থাকা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
প্রচলিত আইন, বিধি দিয়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম ও রোগ নির্ণয়কেন্দ্র পরিচালনা করতে হবে। এসব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। চিকিৎসক হিপোক্রিটাস শপথ, জেনেভা ঘোষণা, হেলসিংকি ঘোষণা, সেবক ও সেবিকা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল শপথ অনুযায়ী রোগীকে সেবা দেবেন।