দণ্ড মওকুফের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
দণ্ড মওকুফ করার যে ক্ষমতা সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া আছে তা বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘সব কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন করা যায় না। জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করতে হলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির হাতে এ সমস্ত ক্ষমতা থাকতে হয়।’ মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যাতে ভবিষ্যতে কখনো রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা না পায় সে জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধনের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। সম্প্রতি আইনমন্ত্রীও এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের গুরুত্ব ও অর্জন তুলে ধরতে গতকাল বিকেলে গণভবনে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এর বাইরে নানা বিষয়, যেমন আগাম নির্বাচন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দণ্ড, জঙ্গিবাদসহ রাজনৈতিক নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী এক এক করে সব প্রশ্নের জবাব দেন।
নির্বাচনসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচন সময়মতো হবে। যে যার মতো বুঝে নিক। যার যার ব্যাপার।’ তিনি বলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রে ও রীতিনীতিতে যেকোনো সময় নির্বাচন হতে পারে। সাংবিধানিকভাবে একটা সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। তবে অনেকে আগাম নির্বাচন দেয়, অনেকে পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে নির্বাচন দেয়। একটা নির্বাচনের পর আরেকটা নির্বাচন হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটাই নিয়ম।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সালেও ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগই একমাত্র পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থেকেছে। এর আগে আর কেউ পারেনি।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন ছিল : দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, ‘হ্যাঁ, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন ছিল।’
বিএনপিকে আনতে অনেক পদক্ষেপ ছিল : শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘এ নির্বাচনে যাতে বিএনপি আসে এ জন্য অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। তারা নির্বাচনে আসল না এবং নির্বাচন করতেও দেবে না বলে ঘোষণা দিল।’
তাদের দেশে কেন যুদ্ধপরাধের বিচার হচ্ছে : মানবতাবিরোধী অপরাধে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায়ের পর মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার হচ্ছে, তা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী করছি। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নতুন নয়। তাদের যদি এতই উদ্বেগ, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের দেশে এখনো কেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার হচ্ছে? তাদের দেশে হবে, আমাদের দেশে কেন হবে না?’
গাজায় নির্বিচারে হত্যার সময় উদ্বেগ শুনি নাই : শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি তাদের প্রশ্ন করি, গাজায় যখন নারী-শিশু নির্বিচারে হত্যা করা হলো তখন তাদের উদ্বেগের কথা তো শুনি নাই। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে- এমনটা বলতে শুনি নাই।’
নিজামীকে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের মানবাধিকার নিয়ে যদি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তাহলে জঙ্গিবাদ বন্ধ হবে কী করে?’
এ সম্পর্কিত অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তাঁর সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরে কোনো পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা হয়নি। এ ব্যাপারে কেউ কোনো প্রশ্নও তোলেনি। তবে তিনি বলেন, কারো কারো ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতেই পারে।
যারা ব্যর্থ দেখে তারা নিজেরাই ব্যর্থ : বিএনপির অভিযোগ আরব আমিরাতের সফর সফল হয়নি, ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে ফটোসেশন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা ব্যর্থ দেখে তারা নিজেরাই ব্যর্থ। নির্বাচনে আসল না, নির্বাচন করতে দেবে না- হুমকি দিল। নির্বাচন হয়েছে, বানচাল করতে পারেনি। সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। হুমকি দিল আন্দোলনের, সেখানেও সফলতা পেল না, জনগণ সায় দেয়নি। ব্যর্থ হলো। যারা ব্যর্থ তারা তো ব্যর্থ দেখবে। এটা তাদের মজ্জাগত। তারা তাদের দেখা দেখুক, আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই।’
জঙ্গি নিয়ে ভারতের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনাসংক্রান্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ দেশে একসময় জঙ্গি তৎপরতা ছিল, এটা ঠিক। আমরা এসে তা বন্ধ করেছি।’ শেখ হাসিনা জানান, এ বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে মতবিনিময় চলছে। তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে। যেকোনো জঙ্গি তৎপরতা রোধ করতে সব প্রতিবেশী রাষ্ট্র একমত। এ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া তথ্যও যাচাই-বাছাই চলছে।
আমার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই : শেখ হাসিনার ব্যাপারে জনগণ উদ্বিগ্ন- এমন এক মন্তব্য প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো এক্সটেনশন টাইম পার করছি। আমার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমার ওপরে নানাভাবে আঘাত এসেছে। গ্রেনেড, বোমা-গুলি সবই মারা হয়েছে। আমাকে নিয়ে আমি আর উদ্বেগ বোধ করি না। জন্মালে মরতে হবে। আল্লাহ যেদিন মৃত্যু লিখে রেখেছেন সেদিন যেতেই হবে। তার আগে বাংলাদেশের জন্য যেটুকু উন্নয়ন করার আল্লাহ লিখে রেখেছেন, সেটা করেই যাব। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেই আমার ছুটি। এ জন্য ২০২১ লাগবে না, তার আগেই হবে।’
সফর সফল : প্রশ্নোত্তর পর্বের আগে লিখিত বক্তব্যে শেখ হাসিনা তাঁর সফরকে সফল উল্লেখ করে বলেন, ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং টেকনাফ থেকে মিরসরাই পর্যন্ত ড্রাইভওয়ে নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সফরের বিভিন্ন বৈঠকে আলোচনায় শ্রমিক নিয়োগের বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরো প্রসারিত করা ও সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করার বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। পর্যটন, অবকাঠামো উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রভিত্তিক ব্লু ইকোনমি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে আমরা একমত হয়েছি। এর ফলে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শুধু জনশক্তি রপ্তানিতে সীমাবদ্ধ না থেকে নতুন নতুন বিষয়ে ব্যাপ্তি লাভ করবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে আমার সরকারের কর্মপরিকল্পনা আরব আমিরাতের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাঁদের সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাই।’ তিনি বলেন, ‘আরব আমিরাতের সরকার আমার সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতে সফলতার জন্য আমাকে অভিনন্দন জানায়। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে আমরা বাস্তবায়ন করছি জেনে সে দেশের সরকার প্রশংসা করে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আরব আমিরাত সরকারকে বাংলাদেশিদের জন্যে সে দেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে সব বাধা দূর করার অনরোধ জানাই। ভিসা প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য আমি তাদের অনুরোধ জানাই।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেছি। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধিতে আমাদের উদ্বেগের বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দুই দেশ আরো ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে একমত পোষণ করি। এ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী অবদান রাখবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’