জামায়াতকে অবিশ্বাস আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত বিএনপি
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব বাড়ছে। বেশ কিছু ঘটনায় সে ইঙ্গিত ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সর্বশেষ গোলাম আযমের মৃত্যুতে বিএনপির আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশ না করার ঘটনায় এই দুই দলের মধ্যে টানাপড়েনের বিষয়টি আরো বেশি করে আলোচনায় এসেছে। এ পরিস্থিতিতে জামায়াত অংশ না নিলে ভবিষ্যতে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন গতি পাবে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির অবিশ্বাসের সূচনা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার কার্যক্রম ঝুলে যাওয়ার ঘটনায়। বিএনপি নেতাদের ধারণা, এর নেপথ্যে আছে সরকারের সঙ্গে তাঁদের জোটসঙ্গী দলটির গোপন আঁতাত। বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হলেও কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণায় বিলম্ব এবং বিশেষ করে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর শাস্তি কমে যাওয়ার পর বিএনপিতে নানা প্রশ্ন ওঠে। সর্বশেষ গোলাম আযমের মৃত্যুর পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে জানাজার অনুমতি বিএনপির সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে দলের শীর্ষনেতা গোলাম আযমের মৃত্যুতে বিএনপির শোক প্রকাশ না করার ঘটনা জামায়াতকে ক্ষুব্ধ করেছে।
সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষের একটি অংশের সম্পর্ক কখনোই মসৃণ ছিল না, এখনো নেই। বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে কয়েকবারই চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে অভিযোগ করেছিলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেও দলটির নেতা-কর্মীরা নেতিবাচক কথাবার্তা বলেন। জাতীয়তাবাদী দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি লন্ডনে এক সভায় বলেন, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক নয়। ওই সময় জামায়াত নেতারা বেশ নাখোশ হন। একমাত্র খালেদা জিয়া কিছুটা নমনীয় থাকায় জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক এখনো টিকে আছে। অন্যথায় আরো আগেই দলটি জোট ছাড়ত বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র। জোটের বিভিন্ন কর্মসূচিতে গাছাড়া ভাব দেখে সম্প্রতি ২০ দলীয় জোটের এক বৈঠকে খালেদা জিয়া সরাসরি জামায়াতের এক নেতার কাছে জামায়াতের রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চান।
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে রায় হওয়ার পর জামায়াত-শিবির সহিংস আন্দোলনে নামে। সে সময় শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চও লাগাতার কর্মসূচি শুরু করে। ওই আন্দোলনে সরাসরি সমর্থন দেওয়ার জামায়াতি আহ্বানে তখন সারা দেয়নি বিএনপি। তখন থেকেই দল দুটির মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। যে কারণে গত বছর ২৯ ডিসেম্বর বিএনপি ঘোষিত জোটভিত্তিক ‘গণতন্ত্রের জন্য অভিযাত্রা’ নামের কর্মসূচিতেও জামায়াতের সমর্থন ছিল না। ফলে ওই কর্মসূচি সফল হয়নি। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকারের বিরুদ্ধে জামায়াত বড় ধরনের কোনো আন্দোলন করেনি।
গোলাম আযমের মৃত্যুর পর দুই দলের মধ্যে দূরত্ব আরো প্রকট হয়েছে। শোক প্রকাশ না করা ছাড়াও তাঁর জানাজায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দেখা যায়নি। তবে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ব্যক্তিগতভাবে গোলাম আযমের মৃত্যুতে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। শান্তিপূর্ণভাবে জানাজা অনুষ্ঠানে সরকারের সহায়তা বিএনপি স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। বিশেষ করে প্রয়াত গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আযমী প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর পর এই সন্দেহ আরো দানা বেঁধেছে। জানাজা শেষে সংক্ষিপ্ত এক বক্তৃতায় আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, ‘ধন্যবাদ জানাই পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। ধন্যবাদ জানাই বায়তুল মোকাররমের খতিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে। আরো ধন্যবাদ জানাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে। তারাও সহযোগিতা করেছে জানাজা সুসম্পন্ন হওয়ার জন্য।’
জামায়াতের সঙ্গে টানাপড়েনের ব্যাপারে বিএনপির সিনিয়র নেতারা নিশ্চুপ থাকলেও মাঠের একাধিক নেতা জানান, জামায়াত জোট শরিক। মানবতাবিরোধী অপরাধ অন্য বিষয়। এর বিচার সবাই চায়। কিন্তু কেউ মারা গেলে শোকবার্তা দেওয়া যেতে পারে। গোলাম আযমের ব্যাপারেও তাই হওয়া উচিত ছিল। জামায়াতের একাধিক নেতা জানান, গোলাম আযম মারা গেছেন। তাঁর ব্যাপারে বিএনপি শোকবার্তা দেয়নি। এতে আমাদের কোনো আপসোসও নেই। তবে আন্দোলনের ব্যাপারে ওই নেতারা বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচি যথাসময় শুরু হবে। বিএনপি কী করবে সেটা তাদের ব্যাপার। জোটের আন্দোলন আর দলের আন্দোলন এক নয়।’