আট অভিযোগ থেকে যে কারণে খালাস পান নিজামী
একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনাকারী জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে আট অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হলেও তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত আরো আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, হত্যা ও ধর্ষণের চারটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং চারটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় নিজামীকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে গত বুধবার নিজামীকে এ শাস্তি দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
তাঁর বিরুদ্ধে অর্ধেক সংখ্যক অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে ওই সব অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করেন, পর্যাপ্ত সাক্ষী হাজির করা হয়নি, প্রত্যক্ষদর্শীও হাজির করা হয়নি। যেসব সাক্ষী হাজির করা হয়েছে, তা-ও ছিল দুর্বল। প্রসিকিউশনের ব্যর্থতাকে এ জন্য দায়ী করা হয়েছে।
৫, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতেরবাড়ী গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ২১ জন নিরস্ত্র মানুষ মারা যায়। রায়ে বলা হয়েছে, এ অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য প্রসিকিউশন কোনো সাক্ষীকে পরীক্ষা করার জন্য ট্রাইব্যুনালে হাজির করেনি। এমনকি কোনো দালিলিক সাক্ষ্য-প্রমাণও দাখিল করেনি। তাই নিজামীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রসিকিউশন।
নবম অভিযোগে বলা হয়, মতিউর রহমান নিজামীর দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রাজাকার ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৩ ডিসেম্বর রাতে বেড়া থানার বিশালিখা গ্রামে হামলা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রফুল্ল, মনু, স্বস্তি পরামানিক, জ্ঞানেন্দ্রনাথসহ ৭০ জনকে হত্যা করে। সেখানে ৭২টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। নিজামী এ কাজে সহযোগিতাও করেন। এ অভিযোগের বিষয়ে নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুস সেলিম লতিফ। কিন্তু তিনি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নন। তিনি তাঁর মা, এলাকার বাসিন্দা আজগর আলী মুন্সী, অহেদ আলী প্রামাণিক, শাহজাহান আলী প্রমুখের কাছে শুনেছেন। এ সাক্ষীর ছেলে আমিনুল ইসলাম ডাব্লিউও সাক্ষ্য দেন। তিনিও ঘটনা শুনেছেন। আরো দুজন সাক্ষীও সাক্ষ্য দেন এ ঘটনায়। রায়ে বলা হয়, চারজন সাক্ষীর কেউই প্রত্যক্ষদর্শী নন। প্রসিকিউশন এ অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, আসামি এ অপরাধে অংশগ্রহণ করেছেন, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডু প্রাণ বাঁচাতে ভারতে চলে যান। নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা তাঁর বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এটি ছিল নিজামীর বিরুদ্ধে দশম অভিযোগ। এ ঘটনায় মাত্র একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ কুণ্ডু। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী নন। কাজেই তাঁর সাক্ষ্য আমলে না নিয়ে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, প্রসিকিউশন এ অভিযোগও প্রমাণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ১১ থেকে ১৪ নম্বর অভিযোগ হলো উসকানির। ১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না। ১২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় নিজামী বলেন, পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে শত্রুরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। তিনি পাকিস্তানের শত্রুদের সমূলে নির্মূল করার আহ্বান জানান। ১৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় নিজামী বলেন, হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে রাজাকার, আলবদররা প্রস্তুত। ১৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে এক সুধী সমাবেশে নিজামী প্রত্যেক রাজাকারকে ইমানদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আল্লাহর পথে কেউ কখনো হত্যা করে, কেউ মারা যায়। এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি ছাত্রসংঘের সদস্য, রাজাকার ও অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে উসকানি ও প্ররোচনা দেন বলে দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষ। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর সুনির্দিষ্ট কোনো ধারায় ‘উসকানির অভিযোগ উল্লেখ নেই। তবে ওই আইনের ৩(২)(এফ) ধারায় ‘আন্তর্জাতিক আইনের অধীন যেকোনো অপরাধ’ হিসেবে উসকানিকে গণ্য করে বিচার করা যায়। কিন্তু এসব অভিযোগের সমর্থনে কোনো সাক্ষীকে পরীক্ষা করার জন্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেনি প্রসিকিউশন। নিজামীর এসব উক্তির সমর্থনে কেবল চারটি পত্রিকার (সংগ্রাম) ক্লিপিং দাখিল করা হয়েছে। ওই সব পত্রিকায় বর্ণিত নিজামীর বক্তব্যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের উসকানি ছিল, তা স্পষ্ট নয়।
১৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী প্রায়ই ওই ক্যাম্পে গিয়ে রাজাকার সামাদ মিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। তিনজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন এ অভিযোগের সমর্থনে। কিন্তু কেউই নিজামীকে রাজাকার ক্যাম্পে উপস্থিত থাকতে সরাসরি দেখেননি। তাই সাঁথিয়া পাইলট স্কুলে নিজামী ষড়যন্ত্র করেন বলে তিনজন সাক্ষী যে সাক্ষ্য দেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফলে এ অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার যোগ্য আসামি।