চাঙ্গা হতে স্বচেষ্ট জেএমবি
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদিন (জেএমবি) আবারো স্বক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা যেমন সরকার উৎখাত এবং দেশে নাশকতা সৃষ্টির পায়তারা করছে, একইভাবে নতুন সদস্য সংগ্রহেও হয়েছে সচেষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ড এবং শুক্রবার জেএমবি’র পাঁচ সদস্য আটকের ঘটনা এরই প্রমাণ বহন করে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র্যাব)- এর একজন মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি বাংলা অনলাইন জানায়, জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-এর যে পাঁচজন সদস্যকে শুক্রবার আটক করা হয়েছে, তারা সংগঠনকে পুনর্জীবিত করার কাজে নিয়োজিত ছিল।
র্যাব মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ হাসান সংবাদ সংস্থাটিকে বলেন, গোয়েন্দা সূত্রের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন জেএমবির সমন্বয়ক আব্দুন নূর কয়েকজন সহযোগীকে সাথে নিয়ে চাপাই নবাবগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর যাচ্ছিলেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই র্যাব-১২ সিরাজগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে তাদের আটক করে।
মাহমুদ হাসান জানান, আটককৃতদের উদ্দেশ্য ছিল নতুন কর্মী সংগ্রহসহ তাদের সংগঠনকে পুনর্জীবিত করা এবং নাশকতা সৃষ্টি করে তাদের অস্তিত্ব সবার সামনে তুলে ধরা।
শুক্রবার আটক জেএমবি‘র প্রধান সমন্বয়ক আব্দুন নূর
আটককৃতদের কাছ থেকে প্রচুর বিস্ফোরক, বিস্ফোরক তৈরির উপাদান এবং জিহাদি বই পাওয়া গেছে বলেও জানা গেছে।
তবে এই জেএমবি দলের সাথে সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আটক জেএমবি গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে যে কথা ধারণা করা হয়েছে, সে কথা নাকচ করে দিয়েছে র্যাব।
এর আগে ভারতের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় জানা যায়, বাংলাদেশের সরকার উৎখাত এবং নাশকতা সৃষ্টির নীলনকশায় মেতেছিল সেখানে অবস্থানরত জেএমবি সদস্যরা।
এর আগে কলকাতার বর্তমান পত্রিকা তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, বর্ধমান কাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ইউসুফের আস্তানাই শুধু নয়, তার আশ্রয়দাতারও খোঁজ পেয়েছে এনআইএ। সর্বশেষ গত গত ২২ অক্টোবর এনআইএ জানতে পারে, শিলিগুড়ির একটি বাড়িতে লুকিয়ে আছে ইউসুফ। সেখানে হানাও দেয় তারা। কিন্তু অল্পের জন্য ফঁসকে যায় ইউসুফ। তবে অপর একটি অসমর্থিত সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, নেপাল পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে ইউসুফ। তবে এনআইএ এখবরের সত্যতা স্বীকার করেনি।
ইউসুফ সম্পর্কে এনআইএ সেময় জানায়, বর্ধমানের মঙ্গলকোটস্থ শিমুলিয়ার কৃষ্ণবাটি গ্রামের ইউসুফ অষ্টম শ্রেণিতে অকৃতকার্য হয়ে উত্তরপ্রদেশের আজমগড় যায় ধর্মীয় শিক্ষা নিতে। সেখানে অবস্থানকালেই সে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এ যোগদান করে সে। ২০০৭ সালে ইউসুফ শিমুলিয়া ফিরে আসে। তখন থেকেই তার সাথে আইএম, সিমি, এবং বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনগুলোর সখ্যতা গড়ে ওঠে। এসব জঙ্গি সংগঠনগুলোর পরামর্শেই সে সেখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। পুরুষ জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিজে নিয়ে সে মহিলা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয় নিজ স্ত্রীর ওপর। এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে আরো কিছু জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলার দায়িত্ব পায় ইউসুফ। শুধু তাই নয়, শেষদিকে বাংলাদেশে নাশকতার দায়িত্বও তার ওপর বর্তায়।
এনআইএ’র বরাত দিয়ে বর্তমান জানায়, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, বাংলাদেশ এবং নেপালেও জঙ্গি নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে জমি কেনে ইউসুফ। উত্তরবঙ্গের কিছু ব্যবসায়ী জঙ্গি কার্যকলাপ পরিচালনা করতে ইউসুফকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে বলে জেনেছে গোয়েন্দারা। এদিকে বাংলাদেশ এবং নেপাল যাতায়াতের সময় উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়িকে ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতো জঙ্গিরা। অপরদিকে নেপালের এক ডাক্তারও মাঝে মাঝে ইউসুফের আস্তানায় এসে তার সহযোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যেতো বলে খবর মিলেছে। সেই নেপালি ডাক্তারের পরিচয় না মিললেও অর্থ যোগানদাতা ব্যবসায়ীদের ঠিকই হদিস পেয়ে গেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এছাড়া জঙ্গিদের ব্যবহারে যেসকল ট্রাভেল এজেন্সি গাড়ির যোগান দিতো, তাদেরকেও নজরদারির মাঝে রাখা হয়েছে।
এদিকে বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদিনের (জেএমবি) সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)।
গত ২৫ অক্টোবর বিবিসি বাংলা জানায়, বর্ধমানে তৈরী হওয়া বোমাগুলি বাংলাদেশে পাঠানোর জন্যই তৈরী করা হচ্ছিল বলেও দাবি করেছে এনআইএ। গোয়েন্দা সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা বর্ধমানের খাগড়াগড়ে ২ অক্টোবরের বিস্ফোরণের প্রাথমিক তদন্ত শেষ করেছে- দুই মহিলা সহ তিনজনকে তারা গ্রেপ্তার করতে পেরেছে আর চতুর্থ ব্যক্তি বিস্ফোরণে আহত হয়ে এখনও হাসপাতালে।
শাকিল আহমেদ এবং শোবহান মন্ডল নামে যে দুই ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিলেন– তাঁরাও বাংলাদেশের নাগরিক বলেই মোটামুটি নিশ্চিত এনআইএ। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ও বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ সহ বিভিণ্ন জেলায় তল্লাশী চালিয়ে উদ্ধার হওয়া নথিপত্র, ফোন রেকর্ড প্রভৃতি ঘেঁটে এনআইএ এখন নিশ্চিত যে, জামায়েতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের সদস্য এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশে পাঠানোর জন্যই নিষিদ্ধ ওই সংগঠনটির সদস্যরা অত্যাধুনিক বোমাগুলি তৈরী করছিলেন।
গোয়েন্দা সূত্রগুলি জানিয়েছে, এই বিস্ফোরণের মাধ্যমে যে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে– যেটা বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড বা তেলেঙ্গানা পর্যন্ত বিস্তৃত– তা একরকম নতুন এবং অজানাই ছিল গোয়েন্দাদের কাছে।
এখন জামায়েতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের এই নেটওয়ার্ক যেমন খুঁজে বার করতে চাইছে এনআইএ, তেমনই জেএমবি-র এই নেটওয়ার্কের ফান্ডিং কীভাবে হত– অর্থাৎ কারা টাকা পয়সা যোগাত এই সন্ত্রাসীদের– সেটাও খুঁজের বার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থাটি। আর তথ্য পাওয়ার জন্য আর্থিক পুরস্কারও ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে গত ১৬ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশেই নাশকতার পরিকল্পনা ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহেদিনের (জেএমবি)।
ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) সেসময় জানায়, তারা পশ্চিমবঙ্গের চারটি জেলা নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের বিভিন্ন গোপন গুদামে অসংখ্য আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্লপ্লোসিভ ডিভাইস) মজুত করা আছে বলে জেনেছে।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণে আহত আব্দুল হাকিম ওরফে হাসানকে (২৩) জিজ্ঞাসবাদের পর এসব তথ্য জেনেছে বলে জানিয়েছে এনআইএ।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, ভারতে যে ৩৬টি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের তালিকা এনআইএ তৈরি করেছে, তার ২৭ নম্বরে রয়েছে জামায়াতুল মুজাহেদিন।
এনআইএ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে হাকিম জানিয়েছে- নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমান এই চার জেলায় শত শত আইইডি মজুত করে রাখা আছে বিভিন্ন গোপন গুদামে। প্রতি জেলায় ওই রকম একাধিক গুদাম রয়েছে বলে হাকিমের বক্তব্য থেকে ইঙ্গিত পেয়েছেন গোয়েন্দারা। আর সেগুলিতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে, এ জন্যই এই ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত এনএসজি (ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড)-র সহায়তা চেয়েছে এনআইএ।
এদিকে গোয়েন্দাদের বক্তব্য, বিস্ফোরণে নিহত শাকিল ও সুবহান বাংলাদেশেরই জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর সদস্য। এনআইএ-র ধারণা, জেএমবি বাংলাদেশে যে রকম জেহাদি কার্যকলাপ করে, তেমনই নাশকতা হাকিম ও তার দলবল ভারতেও ঘটানোর চেষ্টা করছিল।
এদিকে গত ১০ অক্টোবর দৈনিক জনকণ্ঠ তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, জেএমবির জঙ্গীদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে বাংলাদেশ ঘুরে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে টাকার যোগান গেছে বলে খোঁজ পেয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। দুবাইয়ের মাদক ও চোরাকারবারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা পেয়েছে বাংলাদেশের জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের জামায়াতপন্থী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সেই টাকা গেছে বর্ধমানের জঙ্গীদের হাতে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ, জামায়াতী ব্যবসায়ী, সারদা গ্রুপ জঙ্গী কেলেঙ্কারীর অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে খগড়াগড়ে একটি বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে দুই জন নিহত হন। তারা নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) একটি শাখার সদস্য বলে সেসময়ই সন্দেহ করে ভারতীয় গোয়েন্দারা।
তথ্যসূত্র: বর্তমান পত্রিকা, বিবিসি বাংলা, জনকণ্ঠ