দায়মুক্তির দায়ভার- শাহদীন মালিক
দায়মুক্তির দায়ভার এই সমাজ, দেশ ও জাতি কত দিন বইতে পারবে? সব সরকারই মনে করে যে এই দায়ভার আমরা বইতে পারব। দায়মুক্তিতে দেশ ও জাতির কোনো অনিষ্ট হবে না। তাই তারা একের পর এক দায়মুক্তির খেলা খেলছে। এই খেলায় পরাজয় অবধারিত। পরাজয়টা কখন ঘটবে এবং খেসারত কী দিতে হবে, সেটাই দেখার বিষয়। তবে খেসারতটা দিতে হবে দেশ ও জাতিকে।
প্রথম দায়মুক্তি কিছুটা তাত্ত্বিকভাবে ঘটেছিল ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম ছিল ৩৩ অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা ছিল যে অপরাধের অভিযোগ ব্যতীত কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি শুধু অপরাধমূলক কাজ, অর্থাৎ অপরাধের অভিযোগেই কেবল গ্রেপ্তার বা আটক হতে পারবেন। ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর দ্বারা ৩৩ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে বলা হলো ‘নিবর্তনমূলক আটকাদেশ’ দেওয়া যাবে এবং নিবর্তনমূলক আটকাদেশ-সংক্রান্ত আইন অসাংবিধানিক হবে না। অর্থাৎ আইন করে এমন বিধান করা যাবে, যার অধীনে কোনো ব্যক্তি অপরাধ না করলেও সরকার যদি মনে করে যে ব্যক্তিটি দেশ বা সরকারের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ করতে পারে বা করতে উদ্যত হতে পারে, তাহলে সে ব্যক্তিকে আটক করা যাবে। অর্থাৎ জেলহাজতে পুরে রাখা যাবে। কোনো অপরাধ করার দরকার নেই, সরকারের মনে হলেই হবে যে ব্যক্তিটি অপরাধমূলক কাজ করতে পারে, তাহলেই যথেষ্ট। তাকে গ্রেপ্তার করে সোজা কারাগারে।
অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা অনুমতি সাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলে আটকে রাখা যাবে। কিন্তু ‘নিবর্তনমূলক আটকাদেশে’ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে কোনো বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজিরও করতে হবে না, সরাসরি কারাগারে পাঠানো যাবে। এই দ্বিতীয় সংশোধনীর পর যে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ হলো, তাতে কারাগারে আটকে রাখার ব্যাপারে এক অর্থে সরকারকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ শুধু অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করার বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্তি হলো। কোনো ব্যক্তি ‘বিপজ্জনক’ বা অপরাধ করতে পারে, সরকার সে রকম মনে করলেই তাকে আটকাতে পারবে এবং জেলে পুরে রাখতে পারবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। তবে ছয় মাস অন্তর একটা উপদেষ্টা বোর্ডের সামনে আটকে থাকা ব্যক্তিটিকে হাজির করতে হবে।
দ্বিতীয় সংশোধনীর আগে বলা ছিল, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আইন অসাংবিধানিক বা বাতিল হবে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে বলা হলো যে এখন থেকে সংবিধান সংশোধনী আইন মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হলে সে আইন বাতিলযোগ্য হবে না। অর্থাৎ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান সংশোধনী আইন করার বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হলো।
দ্বিতীয় সংশোধনীতে বহিঃশত্রুর আক্রমণ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এমনকি অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণাসংক্রান্ত ক্ষমতা দেওয়া হলো। জরুরি অবস্থা জারি করলে বিরোধীদের জেলে পোরা যায়। নিবর্তনমূলক আটকাদেশ বা বিশেষ ক্ষমতা আইনেও কারণে-অকারণে বিরোধীদের কারাবন্দী করা যায়।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে দায়মুক্তি নিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আওয়ামী লীগ ও পরে বাকশাল সরকার তৎকালীন তাদের বিরোধীদের কারাগারে পুরতে পেরেছিল বছর দেড়েক ধরে—১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত। তারপর আওয়ামী লীগের পাস করা বিশেষ ক্ষমতা আইন তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছিল পরবর্তী ২০ বছর ধরে— ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন জাতীয় নেতাসহ বর্তমানের সর্বজনাব তোফায়েল আহমেদসহ নেতারা দুই থেকে চার বছর জেলে ছিলেন এই বিশেষ ক্ষমতা আইনেরই বদৌলতে।
বহিঃশত্রুর আক্রমণের শর্ত থেকে মুক্তি দিয়ে ‘গন্ডগোলে’র অজুহাতে জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষমতা আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবহার করেছিল ১৯৭৪-৭৫-এ বছর খানেকের জন্য। জরুরি অবস্থা জারি করে দেশ শাসন করার যে মজা সেটা উপভোগ করল অন্য সরকারগুলো কম-বেশি ১০ বছর ধরে—১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯। তারপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ আর সর্বশেষ ২০০৭ থেকে ২০০৮।
প্রায় প্রতিবারই ঠেঙানি খেয়েছে আওয়ামী লীগই বেশি।
সংবিধানের বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্তির যে রেওয়াজ চালু হলো দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে এবং চতুর্থ সংশোধনীতে এসে প্রায় সব ধরনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আর আইনের শাসন থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ যে দায়মুক্তি নিয়েছিল, অর্থাৎ সংবিধান সংশোধন করে এমন সংবিধান রচনা, যেটা মানলেই কি আর না মানলেই কি, সেটার ফল বা খেসারত আওয়ামী লীগকেই দিতে হয়েছিল সবচেয়ে বেশি, ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে। বলাবাহুল্য, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারের কোনো সাংবিধানিক বৈধতা ছিল না। কিন্তু ইতিমধ্যেই ‘সংবিধান মানলেই কি বা না মানলেই কি’ গোছের ধারণা চালু হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত বহু লোক ক্ষমতায় এল-গেল—জনগণ শুধু তাকিয়েই থাকল। তারপর ১৯৭৯-এ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সবকিছুর ‘দায়মুক্তি’। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে, সবই সংবিধানসম্মতভাবে হয়েছে বলে গণ্য হবে!
আর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দায়মুক্তি তো ছিলই—ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, যাতে বলা হলো ১৫ আগস্টের খুনখারাবিসহ সব কৃতকার্যের জন্য সবাইকে দায়মুক্তি দেওয়া হলো।
বর্তমান সরকারের প্রিয়পাত্র হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অসাংবিধানিকভাবে ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করেন। চার বছর পর ১৯৮৬ সালে একটা নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সপ্তম সংশোধনী পাস করিয়ে তাতে বললেন, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত সব বেআইনি কাজের জন্য কেউ দায়ী হবে না, সবকিছুই সংবিধানসংগতভাবে হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। অর্থাৎ সবকিছুর দায়মুক্তি দেওয়া হলো আবার।
২.
ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। কিন্তু সংক্ষেপে সারব। ২০০৩ সালের শুরুতেই বিএনপির আমলে সংসদ আইন পাস করল—যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩। ২০০২-এর অক্টোবর থেকে ২০০৩-এর জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর কারণে ৫৭ অথবা ৫৮ জন ব্যক্তি ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যুবরণ করেন। অথবা যৌথ অভিযানে নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হন। বহু লোক আহত-পঙ্গু হন, অভিযানের নামে সন্ত্রাস-সন্ত্রাসী নির্মূল করার চেষ্টা, সম্পত্তি বিনষ্ট করা হয় খুন-জখমসহ। তাই এসব হত্যা, জখম, সম্পত্তি লুট, বিনষ্ট—সবকিছু থেকে যৌথ বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য সংসদ আইন পাস করল। আইন বলেছিল, এসব খুন-জখম-লুটপাট কোনো কিছুর জন্যই কোনো আদালতে মামলা করা যাবে না। সবাইকে সব দায় থেকে মুক্তি দেওয়া হলো।
২০০৩-এর দায়মুক্তি আইনের পর যে র্যা ব আসবে, তা তো ছাগলেও বুঝতে পারত। পরিণতি কী হবে তা শুধু বুঝতে পারেননি তৎকালীন বিএনপির নেতারা। ১০ বছর পরে হলেও এখন বুঝেছেন। ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে যাঁদের দায়মুক্তি দিয়েছিল বিএনপির সরকার, এখন তাঁদের হাত থেকে বাঁচার জন্য র্যা বের বিলুপ্তি চাইছে।
যে দায়মুক্তি দেয়, খেসারত শেষ পর্যন্ত তাকেই বেশি দিতে হয়।
১৯৭১-এ গোলাম আযম-নিজামী গংয়ের দায়মুক্তি ছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন এই দায়মুক্তি অনাদিকাল থাকবে। কিন্তু অনেক দেরিতে হলেও ফাঁসির দড়ি তাঁদের গলা ছুঁয়ে ফেলেছে।
৩.
‘রাজনৈতিক মামলা’ বলে গত পাঁচ বছরে বেশ কয়েক হাজার মামলা থেকে সরকারি দলের লোকজনকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আর এখন চলছে দুদকের দুর্নীতি থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার খেলা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে সরকার নিজেদের লোকজনের দায়মুক্তি দেওয়ার একটা খুব ‘চালাকি’পূর্ণ কৌশল বের করেছে। অভিযোগ দাখিল, তদন্ত, মামলা দায়ের এবং শেষ পর্যন্ত তদন্তে কোনো কিছু পাওয়া গেল না বলে আদালত দ্বারা মামলা খারিজ।
দায়মুক্তির অর্থাৎ আইন-সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখানোর নিত্যনতুন তরিকা বের করতে আমরা নিঃসন্দেহে সিদ্ধহস্ত হয়ে গেছি। কুবুদ্ধির অভাব নেই। যে দায়মুক্তির উল্লাসে বিভোর থাকে, তার খেয়ালই থাকে না যে একদিন দায়মুক্তির খেসারত দিতে হবে। অতীতে যারাই দায়মুক্তির ‘সুবিধা’ পেয়েছে, খেসারত শেষ পর্যন্ত তারাই দিয়েছে।
দায়মুক্তি থাকলে আইন আর সমাজ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না, পারবে না। মাস দুয়েক আগে গৃহযুদ্ধের মধ্যেও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’র কারণে তাঁর দেশে নির্বাচন করেন। যথারীতি জয়ী হন। এদিকে গৃহযুদ্ধ আর আইএসের কারণে প্রতি মাসে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার সিরিয়াবাসী। ধারণা করা হয়, এখন পর্যন্ত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে অন্তত আড়াই লাখ লোক। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের মারফত জেনেছি, সেপ্টেম্বরে ইরাকে গাড়িবোমা বিস্ফোরণে মারা গেছে এক হাজার ১০০ মানুষ।
ওই সমাজ-জাতি-দেশগুলো ভিন্ন ভিন্ন কারণে আইন ও আইনের শাসনের তোয়াক্কা করেনি। আইনের ঊর্ধ্বে থেকে বা দায়মুক্তি দিয়ে ওসব দেশের শাসকেরা ভেবেছিলেন তাঁরা দেশের ভালো করছেন। ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তান থেকে তিউনিসিয়া পর্যন্ত।
আর আমরা দায়মুক্তি দিয়েই চলছি। দায়মুক্তির দায়ভার সমাজ কি বেশি দিন বইতে পারবে? সম্ভবত না।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।