টিভি সিরিয়াল ‘জি’ হুজুরের দৌরাত্ম্য-উম্মে মুসলিমা
কিছুদিন আগেও আমাদের টিভির নাটক নিয়ে অনেক আলোচনা হতো। ভাই-বেরাদারদের তৈরি নাটকগুলো অসাধারণ প্রশংসা অর্জন করেছিল। কি বিষয় আর কি অভিনয়! মনেই হতো না কোনো অভিনয় দেখছি। মনে হতো লুকিয়ে লুকিয়ে কেউ কোনো বাস্তব দৃশ্য ধারণ করে টিভিতে ছেড়ে দিয়েছে। মনে পড়ে, ফারুকীর ৪২০, ঊণমানুষ, ক্যারাম, ছবিয়ালের লস প্রজেক্ট, খসরু+ময়না, টুইন ওয়ান অথবা মাসুম রেজা, সালাহউদ্দিন লাভলু, বৃন্দাবন দাসদের অনন্য সব নাটকের কথা। এখনো যে কিছু ভালো নাটক হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু ‘জি’ হুজুরের দৌরাত্ম্যে সেগুলো মাঠে মারা যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে দাদার আমল থেকেই গোপাল কৃষ্ণ গোখলের সেই উক্তি ‘পশ্চিমবঙ্গ যা আজ ভাবে, ভারত ভাবে তার পরদিন’ শুনে আসছি। কিন্তু ওদের টিভি সিরিয়ালগুলো দেখলে তা মনে হওয়ার বিন্দুমাত্র চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিটি সিরিয়ালের মূল কথা ‘পতিই নারীর গতি’ বা ‘পতি পরমেশ্বর’।
পুত্রবধূর প্রতি শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের অত্যাচার, পরকীয়া, কুসংস্কার, পূজা-পার্বণ, নারীর ডাইনি রূপ, সহিংসতা, কোন্দল, কূটনামি, নীচতায় ভরপুর এসব ছবি। ইদানীং আরও এক ধাপ উত্তরণ হয়েছে। এখন দেখানো হচ্ছে বাল্যবিবাহ। সতী, রাই কিশোরী, রাগে অনুরাগে ইত্যাদি ধারাবাহিকে মেয়েশিশুদের প্রেম, বিয়ে, যৌন হয়রানি ও সতীত্বের জয়গান গাওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরাও এসব দেখেন নাকি? তা না হলে বলা নেই কওয়া নেই কী কারণে বাল্যবিবাহের আইন জারি হতে যাচ্ছিল আল্লাহ মালুম।
জীবন মানে জি বাংলার পৃথিবী যেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পূর্ববর্তী পৃথিবী। কবে না জানি সতীদাহ প্রমোট করার উদ্যোগ গ্রহণ করে জি বাংলা। অবাক লাগে, এসব সিরিয়ালের বেশির ভাগের লেখক নারী। যাদের বাড়িতে একটা টিভি, তাদের হয়েছে মুশকিল। আমরা এখনো গৃহসহকারীনির্ভর। তার ওপর ঘরের বাইরে নারীর কাজের ক্ষেত্র দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। একই সঙ্গে নাগরিক জীবনে ছোট হয়ে আসছে পরিবার। গৃহসহকারীদের সন্তুষ্ট না রাখতে পারলে ‘কালই গার্মেন্টসে জয়েন করব’ বলে হুমকি দিতে থাকেন। ঘরের বাইরে কাজ করা নারী নিজের ছোট সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের হাতে টিভির রিমোট ছুড়ে দেন। কোনো কোনো বাড়ির আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সন্ধ্যার আগেই সব কাজকর্ম-লেখাপড়া সেরে বসে পড়েন ‘জি’ হুজুরের সামনে। একজন ‘জি’ নেশাগ্রস্ত উচ্চশিক্ষিত পুরুষকে সন্ধ্যায় কোনো অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালে তিনি রাত ১১টার আগে সেখানে যেতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। কারণ, রাত ১১টা নাগাদ পর পর প্রচারিত তাঁর পছন্দের সিরিয়াল শেষ না করা পর্যন্ত তাঁর মরারও সময় নেই। একজন শিক্ষিত নারী বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কারণে তিন দিন জি দেখার সুযোগ পাননি, তিনি টেলিফোনে তাঁর গৃহসহকারীর কাছ থেকে রাশির বর্তমান অবস্থা জেনে নিয়ে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হলেন। ১০ বছরের এক ছেলেশিশুকে বয়েই গেল থেকে উঠিয়ে পড়ার টেবিল নিয়ে যাওয়া হলে সে হাত-পা ছুড়ে মরাকান্না জুড়ে দিল।
পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়াল/নাটকের মধ্যে খুব অদ্ভুত বৈপরীত্য লক্ষণীয়। ওদের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতারা প্রায় বিশ্বমানের। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত। এক পর্বের নাটকে কিছু ভালো কাজও হয়েছে। কিন্তু এসব অদ্ভুতুড়ে গাঁজাখুরি অলীক সিরিয়ালগুলোর জয়জয়কার কেন? দিন দিন যেন এর অর্বাচীনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওদিকে ‘জি’ বাংলায় ‘মিরাক্কেল’ বলে কৌতুক পরিবেশনার একটা প্রতিযোগিতামূলক সিরিয়াল আসে প্রতিবছর। এর অবস্থা আরও ভয়াবহ। তিন-চার বছর আগে তবু পরিবারের সব ধরনের সদস্যদের নিয়ে ওটা দেখা যেত, ইদানীং ছেলে-বুড়ো সব প্রতিযোগীকে আদিরসের সবক দিচ্ছে এর মেন্টররা। যেন আদিরস ছাড়া মজার কৌতুক হতেই পারে না।
এখন প্রশ্ন, এসব সিরিয়াল কেন আমাদের দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে? তাহলে ওরা কি বাংলাদেশের দর্শকদের মাথামোটা ভাবেন, না মোটামাথা তৈরির এ এক রাজনীতি? যে দেশের দর্শকেরা সকাল-সন্ধ্যা, ঢাকায় থাকি, এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, ভবের হাট ইত্যাদি ধারাবাহিকে সমৃদ্ধ, তারা ‘জি’, ‘জলসা বা ‘স্টার’ টিভির ওসব অখাদ্য গেলেন কী করে? এখনো আমাদের বেশির ভাগ চ্যানেলেই দুটো-একটা করে সিরিয়াল চলে। কিন্তু সেগুলো এখন কেউ আর দেখেন না। ওদের হিন্দি সিরিয়ালগুলোর অনুকরণে আমাদের দু-একটা চ্যানেলে সিরিয়াল চলে। সেটাও দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। এর কারণ কী? হতে পারে অতিবাস্তবতা এসব দর্শকের বিনোদন দিতে অক্ষম, তাঁরা অবাস্তবতাকে মিথ্যা জেনেও খানিকটা নির্ভেজাল আনন্দ খোঁজেন। কোথায় যেন পড়েছিলাম এ যেন রিকশাওয়ালাদের ময়ূরী (আমাদের সিনেমার স্থূলকায় নায়িকা) টাইপ নায়িকা পছন্দের মতো। ঘরের বউদের হাড্ডিসার শরীরে কোনো আবেদন না পেয়ে ছায়াছবির টইটম্বুর মেদ-মাংস দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটানো। এমনো হতে পারে সিরিয়ালগুলো তৈরির কৌশলও দর্শকদের ধরে রাখছে। এদের সেট, সাজপোশাক, অভিনয়, চাকচিক্য দর্শককে টানে বা এমনভাবে পর্ব শেষ হয়, যাতে পরেরটা দেখার আকর্ষণ থেকে যায়। কিন্তু এ কথাও তো মিথ্যে নয় যে আমাদের সকাল-সন্ধ্যা, এইসব দিনরাত্রি বা ভবের হাটও বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করেছে? তাহলে এখন অবাস্তবতা দেখার জন্য দর্শকদের মানসিকতা পরিবর্তন হলো কেন? নাকি সে মাপের (হুমায়ূন আহমেদীয়) সিরিয়াল হচ্ছে না বলে ‘জি’ বাংলা স্থান দখল করে নিল?
আমার বিশ্বাস, ‘জি’ বাংলার উদ্ভট সিরিয়াল আমাদের দর্শকদের আনন্দ দিলেও তা তাঁরা কেবল আনন্দ হিসেবেই গ্রহণ করেন, নিজেদের জীবনে অনুসরণের জন্য নয়। তাঁরা দেখেন আর বলেনও ‘এ কী আজগুবি কাণ্ড রে বাবা!’ তবে ক্ষতি যা তা হচ্ছে দর্শকদের চেতনাবোধের উত্তরণ ঘটছে না। হুমায়ূন আহমেদকে বলা হয় তিনি তাঁর উপন্যাসের মাধ্যমে মানুষকে বইমুখী করেছিলেন, পাঠক তৈরি করে দিয়েছিলেন। এখন জি বাংলা যদি অন্ধকার যুগের মধ্যে আমাদের দর্শকদের স্থাণু করে রাখে, তাহলে কি চেতনার উৎকর্ষ সাধিত হবে? সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত বেশ ভালো নাম করেছে ওদের একটা বাংলা চলচ্চিত্রের কোনো এক চরিত্র বলছিল, ‘এসব সিরিয়াল বাংলাদেশিদের জন্য তৈরি করা হয়। এগুলো বাংলাদেশিরাই দেখে।’ তো পরিকল্পিতভাবেই যদি ওরা সাংস্কৃতিক স্থবিরতার জালে আমাদের আটকে রাখার দুরভিসন্ধি করে থাকে, তাহলে ওসব অসভ্য বর্বর দৃশ্যায়ন দেখার সুযোগ বন্ধ করে দিতে হবে, নাহয় নিজেদের সুকৃতি দিয়ে দর্শককে ফেরাতে হবে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।