বিধবাদের চোখে আনন্দাশ্রু
‘মরবার আগে আমার স্বামী ও পুলারে যারা মারছে তাগোরে ফাঁসি দেইখ্যা মরবার বড় আশা মনে আছিল। আইজ কামারুজ্জামানের ফাঁসির সাজার কতা হুইন্না বুহের ভিতর থাইক্কা একটা চাপা দেয়া পাত্তর হইরা (সরে) গেল।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেনে একাত্তরে শহীদ খেজুর আলীর স্ত্রী জরিতন বেওয়া।
সোমবার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা শেরপুরের আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় পুনর্বহালে শত কষ্টের মাঝেও নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর বিধবাপল্লীতে শহীদ পরিবারের বিধবা ও স্বজনদের চোখে এখন আনন্দের অশ্রু বইছে।
একাত্তরে জরিতন বেওয়ার স্বামী, সন্তান-স্বজনসহ পরিবারের আট জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অতীতের স্মৃতি হাতড়ে জরিতন বেওয়া বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমার স্বামীরে ঘর থেইক্যা টাইন্যা লইয়্যা উঠানে ফালাইয়্যা পরথমে ছয়ডা গুলি করে। গুলি খাইয়্যা পানি চাইলে আরেকটা গুলি করে। ওই গুলিতে উডানেই তার জীবন যায়। পরে আমার সোনা মানিক বুকের ধন হাশেমরে ধইর্যাল নিয়্যা বাপের লাশের উফরে ফালাইয়্যা গুলি করে। এরপর আমার দেওররে ধইর্যাা নিয়্যা বন্দুকের নল দিয়্যা কেচাইতে থাহে, পরে মুহের ভিতরে বন্দুক দিয়্যা গুলি করে। তহনি তার পরাণ বাইর হইয়্যা যায়।’
শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া বলেন, ‘যারা আংগর বেডাইনরে (পুরুষ মানুষ) মারছে, ওগোর নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির সাজা অইছে, হুইন্না আংগর কইলজাডা তাও ইট্টু জুড়াইছে।’
সেদিনের সেই হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে চাইলে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ জসিমুদ্দিনের স্ত্রী বিধবা নূরেমান বেওয়া, বিধবা সমলা বেওয়া ও করফুলি বেওয়া।
তারা জানান, পাক বাহিনী তো আর আমগো এলাকা চিনতো না। রেজাকার-আল-বদররাইতো তাগোরে পথ দেহাইয়া এই গেরামে মুক্তি আছে কইয়া আনছে, ম্যাছাকার করছে। আমগোরে বিদুফা (বিধবা) করছে, স্বামী-সন্তানহারা করছে। কামরুজ্জামান আছিল ওগোর নিডার (নেতা)।
অহন অক্তের (রক্তের) বদলে কামরুজ্জামানের অক্ত নেয়ার ফাঁসির সাজা অইছে, আমরা খুশি অইছি।
শহীদ ছফির উদ্দিনের দুই ছেলে জালাল উদ্দিন ও আলাল উদ্দিন বাংলামেইলকে জানান, কামরুজ্জামানের ফাঁসির রায়ে তারা খুশি। বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারের স্বজনরা সবাই খুশি। তবে তারা এখন আতঙ্কের মধ্যে আছেন। কামারুজ্জামানের লোকেরা নানাভাবে তাদের শায়েস্তা করা হবে, ক্ষমতা পরিবর্তন হলে দেখে নেয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে আসছে।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বর্বর পাকিন্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায় নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। সেদিন পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা ছয় ঘণ্টার তাণ্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন। এদিন ভোরে পাক বাহিনী সোহাগপুর গ্রামে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষদের। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘বিধবা পল্লী’।
তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের নির্দেশে সোহাগপুরে এ গণহত্যা সংগঠিত হয়।
শহীদ পবিারেরর বিধবারা বাংলামেইলকে জানান, আল-বদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নির্দেশে স্থানীয় রাজাকার কাদির ডাক্তারের নেতৃত্বে গ্রামের প্রফুল্ল দিঘী থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা গ্রামের ছেলে, বুড়ো, শিশু যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই পাখির মত গুলি করে হত্যা করেছে।
বিধবারা জানান, মধ্যযুগীয় কায়দায় নরঘাতকের দল স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে সন্তানকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছে। প্রায় ছয় ঘণ্টা তাণ্ডবের পর হায়েনার দল সোহাগপুর ত্যাগ করে। আবার হানাদার পাকবাহিনী আসবে বাড়িঘর জ্বালাতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রিয় স্বজনের লাশ কেউ কলপাতা, কেউ শাড়ি, গামছা, আবার অনেকেই মশারি দিয়ে পেঁচিয়ে কোনোমতে গর্ত করে এক কবরে ৫-৭ জনকে মাটিচাপা দিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।
বর্তমানে শহীদ পরিবারের ৩৪ জন বিধবার কেউ বয়স্ক ভাতা, কেউবা বিধবা ভাতা এবং ট্রাস্ট ব্যাংক ও ব্র্যাকের যতসামান্য মাসিক ভাতার ওপর কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। তারপরও কামারুজ্জামানের পাশাপাশি স্থানীয় রাজাকারদেরও বিচার দাবি করেন বিধবাপল্লীর বাসিন্দারা।