রিভিউ ও রায় কার্যকর হওয়া প্রসঙ্গে – মিজানুর রহমান খান
যুদ্ধাপরাধীদের আপিল নিষ্পত্তি করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ টানা তিনবার বিভক্ত রায় দিলেন। সেদিক থেকে আজকের রায়ের মধ্য দিয়ে বিভক্ত রায় প্রদানের ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে। অবশ্য আইনগত কোন প্রশ্নে এই বিভক্তি, তা তাৎক্ষণিকভাবে আজও জানা যায়নি। কাদের মোল্লার মামলায় ৪: ১, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় ৩: ২: ১ ভোটে বিচারকেরা বিভক্ত হন। আজকের রায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে হয়েছে। তবে অনুপাত জানা যায়নি।
এখন সবচেয়ে বেশি আগ্রহের বিষয় হলো, কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কবে, কখন কার্যকর হতে পারে। এর প্রথম উত্তর হলো, সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। তবে এ জন্য পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
কারাবিধি অনুসারে পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাবে। তবে যখন তারা জানবে, কামারুজ্জামানের আপিল খারিজ হয়ে গেছে, সেই মুহূর্ত থেকে ফাঁসি দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করবে। প্রক্রিয়া শুরুর ২১ দিন পর এবং ২৮ দিনের আগে ফাঁসি কার্যকর করার নিয়ম। তবে এর মধ্যে যদি সংক্ষুব্ধ পক্ষ আবেদন করে, তখন তা সর্বোচ্চ আদালতের ওপর নির্ভর করবে।
উল্লেখ্য, কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে রায় ঘোষণা এবং পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশে ৭৮ দিন সময় লেগেছিল। প্রচলিত আইনে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশে কোনো বাঁধা ধরা নিয়ম নেই। এবারে পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে ৭৮ দিন কিংবা তার চেয়ে অনেক কম বা বেশি সময়ের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
এরপর রয়েছে রিভিউর প্রশ্ন। ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ কাদের মোল্লার মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরেই তাঁর ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে আসামিপক্ষের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে চেম্বার জজ ১০ ডিসেম্বরে ফাঁসির আদেশ স্থগিত করেছিলেন। কাদের মোল্লার পক্ষে দুটি রিভিউ আবেদন পড়েছিল। ১১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে পুনর্বিবেচনার আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুনানি হয়। ১২ ডিসেম্বর অপরাহ্ণ প্রধান বিচারপতি কেবল ঘোষণা দেন যে, ‘বোথ দ্য ক্রিমিনাল রিভিউ পিটিশনস আর ডিসমিসড।’ কিন্তু তাতে কী কারণে খারিজ হয়েছে তা স্পষ্ট হয়নি। জামায়াতের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত ফাঁসি স্থগিত করা যায় না মর্মে মত দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে অবশ্য ১২ ডিসেম্বর বিকেল সোয়া চারটায় পৌঁছায়, আর ফাঁসি কার্যকর হয় রাত ১০টা এক মিনিটে।
সে কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিদ্যমান আইনে রিভিউ করার সুযোগ আছে কি নেই—এ নিয়ে যে আইনি তর্ক, তা অমীমাংসিত রয়েছে। আজও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং কামারুজ্জামানের রিভিউ প্রশ্নে আইনজীবী পরস্পরবিরোধী মত দিয়েছেন। এর আগে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও অভিন্ন মত দিয়েছিলেন যে, যেহেতু একটি বিশেষ আইনে বিচার হচ্ছে এবং সেই আইনে রিভিউ করার অধিকারের কথা বলা নেই। তাই এই সুযোগ তারা পাবে না। কিন্তু সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘সংসদের যেকোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ প্রণীত যেকোনো বিধি সাপেক্ষে আপিল বিভাগের কোনো ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা ওই বিভাগের থাকবে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ২১ ধারায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরকার ও আসামিপক্ষকে আপিল আবেদনের অধিকার দিয়েছে। কিন্তু আপিল পুনর্বিবেচনার আবেদন করা যাবে কি না—এ বিষয়ে আইনে কিছু উল্লেখ নেই। ২০(৩) ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীনে শাস্তি দেওয়া হলে সরকারের আদেশ অনুসারে তা কার্যকর হবে। ২০১২ সালে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক মত দিয়েছিলেন যে সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল পুনর্বিবেচনার আবেদন করার অধিকার দণ্ডিতের আছে। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘এ অধিকার যদি দেওয়া হয়, তাহলে রায়ের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো দিন প্রশ্ন উঠবে না।’
আমি তাঁর ওই দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছিলাম। অনলাইনেও মত দিয়েছিলাম। আমি মনে করি, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদই কেবল নয়, এখানে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য ১০৪ অনুচ্ছেদ। এখানে ‘ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজন হইতে পারে, সেইরূপ আদেশ’ প্রদান এবং ‘ কমপ্লিট জাস্টিস’ নিশ্চিত করতে আপিল বিভাগের ব্যাপকভিত্তিক এখতিয়ার স্বীকৃত।
সম্প্রতি আইন ও বিচারমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলো। বললাম, রিভিউ প্রশ্নে আপনি আগের মতে অটল রয়েছেন কি না? তিনি তাঁর সম্মতি ব্যক্ত করলেন।