কামারুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাতে কারাগারে স্বজনেরা
আজ বুধবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ হিসেবে পরিবারের সবাই এই মাত্র কারা ফটকে এসেছি।’
কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী বলেন, ‘কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে আবেদনটি আমার হাতে এসেছে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সংগঠক কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে এ দণ্ড দিয়েছিলেন।
৪৩ বছর আগের আলবদরের সংগঠক কামারুজ্জামান বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি জামায়াতের দ্বিতীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে চূড়ান্ত মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেলেন।
এর আগে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ওই রায় কার্যকর হয়।
একাত্তরে বর্তমান শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে গত বছরের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন কামারুজ্জামান।
গত সোমবার আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের এ আপিল আংশিক মঞ্জুর করেন। সোহাগপুর গণহত্যার দায়ে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়। তবে গোলাম মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের জন্য কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ।
আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) সুযোগ ও রায় কার্যকর করা নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ ভিন্নমত দিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই। আর আসামিপক্ষ বলেছে, পুনর্বিবেচনার সুযোগ সাংবিধানিক অধিকার। এর আগে রায় কার্যকর করা ঠিক হবে না।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এটি আপিল বিভাগের তৃতীয় রায়। এর আগে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গঠন করা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। ওই পাঁচটি অভিযোগে খালাস চেয়ে আপিল করেছিলেন কামারুজ্জামান। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল।
চার অভিযোগ চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত: কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ, একাত্তরের ২৯ জুন কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদরের সদস্যরা শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলার রামনগর গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্পে নিয়ে সারা রাত নির্যাতন করেন। পরদিন তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। তবে আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতিক্রমে খালাস দিয়েছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি একদিন কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগ এ দণ্ড বহাল রেখেছেন।
তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় ও নারী ধর্ষণ করে। ওই বর্বরতার পর থেকে গ্রামটি বিধবাপল্লি নামে পরিচিত। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে এ অভিযোগে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের ভিত্তিতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
চতুর্থ অভিযোগ: একাত্তরের ২৩ আগস্ট রাতে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদরের সদস্যরা শেরপুরের মোস্তফাবাগ থানার গৃদ্দা নারায়ণপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাসেমকে সেরিহ সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করা হয়। গোলাম মোস্তফা মারা গেলেও আবুল কাসেম নদীতে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান। এই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ তা কমিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।
সপ্তম অভিযোগ: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পবিত্র ২৭ রমজান কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদরের সদস্যরা ময়মনসিংহের কতোয়ালি থানার কাঁচিঝুলি গ্রামের ট্যাপা মিয়া, তাঁর বড় ছেলে জহুরুল ইসলামসহ আরও পাঁচ ব্যক্তিকে বÊহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খঁুচিয়ে হত্যা করেন। তবে এঁদের মধ্যে ট্যাপা মিয়া নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁকে গুলি করা হয়। গুলি তাঁর পায়ে লাগে। এ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ অভিযোগে গতকাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে কামারুজ্জামানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখেন আপিল আদালত।
পঞ্চম অভিযোগ ও ষষ্ঠ অভিযোগ ছিল যথাক্রমে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পবিত্র রমজান মাসের মাঝামাঝি শেরপুরের চকবাজার এলাকা থেকে মো. লিয়াকত আলী, মুজিবুর রহমানসহ ১০ জনকে আহম্মেদনগর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের কাছে গুলি করে হত্যা করা এবং একাত্তরের নভেম্বরে টুনু ও জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করে ময়মনসিংহের জেলা কাউন্সিল ডাকবাংলোতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ দুটি অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
রাজধানীর পল্লবী থানায় করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করেন। গত বছরের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলে ৬ জুন তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করেন। গতকাল আপিল বিভাগ তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।