যেখানে ফাঁসি-যেখানে কবর

মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও আলবদর প্রধান মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে তাকে কবর দেওয়া হবে শেরপুরের বাজিতখিলায় গ্রামের বাড়িতে মায়ের কবরের পাশে। এ জন্য জেল কর্তৃপক্ষ ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন।

kamruzzaman_1_0ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দক্ষিণ দিকে সীমানা প্রাচীর ও ভবনের মাঝখানে একটি খালি জায়গায় একটি স্থায়ী ফাঁসির মঞ্চ রয়েছে। যা দৈর্ঘ্যে ৪০ ফুট ও প্রস্থে ৩০ ফুট। মঞ্চের পাটাতন কাঠের এবং এই কাঠের নিচে কুয়া সদৃশ গর্ত। যুগের পর যুগ এই স্থানটিকেই ফাঁসির স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জেলখানায় এই স্থানটি ফাঁসির মঞ্চ নামে পরিচিত।

জেল কর্মকর্তাদের মতে, ফাঁসি কার্যকর করার আগে মঞ্চটিকে ঘিরে প্যাণ্ডেল টাঙ্গানো হয়। যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ প্যাণ্ডেলের ভেতরের ঘটনাবলি দেখতে না পারে। এরপর সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে মৃত্যুদণ্ড তথা ফাঁসি কার্যকর করা হয়। গত বছর ১৩ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।

ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার বৃহস্পতিবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই মঞ্চেই মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে। এ জন্য তারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, সাধারণ অপরাধীদের ফাঁসি দেওয়া হয় কাশিমপুর জেলে এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয় স্পর্শকাতর ব্যক্তিদের।

তিনি জানান, ফাঁসি কার্যকরে কেন্দ্রীয় কারাগারে তিন জন জল্লাদ রয়েছেন। প্রয়োজনে অন্য কারাগার থেকে আরও জল্লাদ আনা হতে পারে। জল্লাদ সরদার শাজাহান বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে অবস্থান করছেন বলে জানান তিনি।

শেরপুরের বাজিতখিলায় গ্রামের বাড়িতে কামারুজ্জামানের মায়ের কবর। ফাঁসি কার্যকর হলে এর পাশেই তাকেও দাফনের সম্ভাবনা রয়েছে।

শেরপুর প্রতিনিধি জানান, শেরপুর শহরের থানার মোড় থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার উত্তর দিকে সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের কুমড়ি মুদিপাড়া গ্রামে মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বাড়ি। কামারুজ্জামানের দাপটের কারণে এক সময় বাজিতখিলা ইউনিয়নটি মিনি পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত ছিল।

বৃহস্পতিবার মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বড় ভাই মোহাম্মদ আলমাস উদ্দিন বলেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে গ্রামের বাড়ির কাছে মসজিদের সামনে পারিবারিকভাবে কামারুজ্জামানের জানাজা হবে। এরপর মা সালেহা খাতুনের কবরের পাশে তাকে শায়িত করা হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে রিভিউ আবেদন এবং কামারুজ্জামানের শেষ ইচ্ছার ওপর। শেষ ইচ্ছার কথা তার ছেলেরা জানিয়ে দেবেন। তিনি অভিযোগ করেন, তার ভাইয়ের ওপর ন্যায়বিচার হয়নি।

শেরপুর জেলা জামায়াতের আমীর ডা. শাহাদাত হোসাইন বলেন, ‘এখনও আমরা নিশ্চিত নই যে, রায় কার্যকর হওয়ার পর সরকার আদৌ শেরপুরে লাশ পাঠাবে কিনা। কারণ কাদের মোল্লার দণ্ড কার্যকরের পর পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর না করে সরকারের লোকজন তার এলাকায় দাফন সম্পন্ন করেছিল। তিনি বলেন, রায় কার্যকরের দিন ধার্য হওয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। রিভিউ আমাদের শেষ ভরসা।

জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বলেন, দলগতভাবে নয়, জানাজা হবে পারিবারিকভাবে। জানাজায় আত্মীয়-স্বজনরা উপস্থিত থাকবেন। তার জানাজার জন্য দলগত কোনও প্রস্তুতির দরকার নেই। এখানে সাংগঠনিক বিষয় জড়িত না।

প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা শাখার অালবদর প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কর্মকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাতটি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।

গত বছর ৯ মে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন অান্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, দু’টি অভিযোগে যাবজ্জীবন ও একটিতে দশ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেন। অবশিষ্ট দু’টি অভিযোগ প্রমাণ হয়নি।

ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গত বছর ৬ জুন আপিল করেন মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। চলতি বছর ৫ জুন আপিল শুনানি শুরু হয় এবং ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়।

অবশেষে গত ৩ নভেম্বর সকাল ৯টা ১০ মিনিটে মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের দায়ের করা আপিলের রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগের বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ। আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া তৃতীয় অভিযোগের (সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর গণহত্যা) ভিত্তিতে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন এবং গোলাম মোস্তফা হত্যার চতুর্থ অভিযোগের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন। এ ছাড়া দুই ও সাত নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এক নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবনের সাজার রায় খালাস করে দেন আপিল বিভাগ।

জানা গেছে, সরকার যে কোনও সময় যুদ্ধাপরাধী মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারে। এ জন্য দায়িত্বশীলদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। তবে কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা বলেছেন, তারা আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ করবেন।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend