মুনীরুদ্দিন আহমদ: আসল ওষুধ নকল ওষুধ
আসল ওষুধের নামে ও অবয়বে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতারণামূলকভাবে নকল উপকরণ দিয়ে, না দিয়ে বা ভেজাল দিয়ে উৎপাদিত ওষুধই ‘নকল ওষুধ’। ব্র্যান্ড ওষুধের মতো জেনেরিক ওষুধও নকল হয়। আবার অনেক ওষুধে ঠিক উপকরণটি ব্যবহার করা হলেও তা পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না। এসব ওষুধ আসলে নিম্নমানের ওষুধ। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ রোগীর জন্য কেন বিপজ্জনক তা খানিকটা বর্ণনা করা যাক।
ওষুধ উদ্ভাবনের সময় দীর্ঘকাল ধরে অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকরা নির্ধারণ করেন কোন ওষুধে রোগ সারানোর জন্য কী পরিমাণে সক্রিয় উপাদান থাকতে হবে। উদাহরণ দিচ্ছি। একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেটে সক্রিয় উপাদান হিসেবে প্যারাসিটামল থাকে ৫শ’ মিলিগ্রাম। সক্রিয় উপাদনের সঙ্গে আয়তন বাড়ানোর জন্য স্টার্চ, ল্যাকটোজ বা অন্যান্য নিষ্ক্রিয় উপাদান যোগ করাসহ ট্যাবলেটের আকার-আকৃতি প্রদানের জন্য অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে ওষুধের পরিপূর্ণ রূপ প্রদান করা হয়। অনেক সময় সক্রিয় উপাদনের পরিমাণ এত কম থাকে যে, (যেমন ১ মিলিগ্রাম) তা দিয়ে ওষুধের আকার-আকৃতি প্রদান করা যায় না। তাই নিষ্ক্রিয় উপকরণ মিশিয়ে আয়তন বাড়িয়ে ওষুধ তৈরি করা হয়।
ওষুধে সক্রিয় উপাদান না থাকলে তাকে ওষুধ বলা যাবে না। প্যারাসিটামল ব্যবহার না করেই শুধু ষ্টার্চ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে এমন ট্যাবলেট তৈরি করা যায় যা দেখলে মনে হবে হুবহু একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। সক্রিয় উপাদান না থাকার কারণে এমন ওষুধ খেলে ব্যথা-বেদনা বা জ্বর সারবে না। সামান্য ব্যথা-বেদনা বা জ্বর সারানোর জন্য নকল প্যারাসিটামল ব্যবহারের কারণে রোগ না সারলেও তা আপনার জীবনের জন্য বিপজ্জনক না-ও হতে পারে, তবে বিষয়টা অস্বস্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক।
কিন্তু এমনসব রোগ আছে যে ক্ষেত্রে আপনি ওষুধ সঠিক মাত্রায় সেবন না করলে রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে এবং একসময় রোগী মারাও যেতে পারেন। সংক্রামক রোগের কথাই ধরুন। এ ধরনের রোগের প্রতিকারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার অপরিহার্য। জীবাণু দ্বারা শরীর বা শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শরীর ও জীবাণুর মধ্যে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে শরীর তার প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা বা অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য জীবাণু ধ্বংস করার কাজ চালিয়ে যায়। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল বা নষ্ট হয়ে গেলে এবং কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা না হলে জীবাণু শরীর ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করে। তার অর্থ হল, স্বাস্থ্যের ক্ষতি এবং পরবর্তীতে অবধারিত মৃত্যু।
নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে কার্যকারিতা না পেয়ে চিকিৎসক বা রোগী একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করতে থাকেন। এভাবে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে জীবাণু ওষুধের কার্যকারিতা নিস্ফল করে দিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে শরীরে বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বর্তমান বিশ্বের ভয়ানক বিপদগুলোর মধ্যে অন্যতম বিপদ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। অন্যদিকে, বেশি পরিমাণে সক্রিয় উপাদান থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়ায় রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে রোগী মারাও যেতে পারেন।
সম্প্রতি ল্যানসেট প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধের মাধ্যমে জানা যায় যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক-তৃতীয়াংশ ম্যালেরিয়ার ওষুধ নকল। গবেষকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি দেশে পাঁচ ধরনের ১৪৩৭টি ম্যালেরিয়ার ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে পান, এসব ওষুধের ৩৬ শতাংশ নকল। এসব নমুনার মধ্যে ৩০ শতাংশ ওষুধে কোনো উপকরণই (অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট) নেই। সাব-সাহারা অঞ্চলের ২১ দেশে ছয় প্রকার ২ হাজার ৫০০টি ওষুধের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ ওষুধ জাল এবং শতকড়া ৩০ ভাগ ওষুধ নিম্নমানের বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১০ সালে সারা বিশ্বে ম্যালেরিয়ায় ৬ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ মারা যান। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ এসব মৃত্যুর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, এসব নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের মধ্যে অধিকাংশ হল অ্যার্টেমিসিনিন ও আর্টেমিসিনিন থেকে রাসায়নিকভাবে উদ্ভাবিত অন্যান্য ওষুধ। আর্টেমিসিসিন ও এই গ্রুপের ওষুধগুলো এখন পর্যন্ত ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর ও অগ্রগামী ওষুধ বলে বিবেচিত হয়। কারণ ম্যালেরিয়ার অন্যান্য ওষুধের বিরুদ্ধে ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট ইতোমধ্যে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই আতঙ্কজনক সমস্যার কারণ মূলত বহুবিধ। আত্মচিকিৎসার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকারে ওষুধের নির্বিচার অপব্যবহার, ম্যালেরিয়ার ওষুধের যথাযথ গুণগতমান নিশ্চিতকরণে ব্যর্থতা এবং অসাধু নকলবাজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানে অনীহা ও ব্যর্থতা উল্লিখিত সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত দশকে ম্যালেরিয়া নির্মূলে যে অভাবনীয় বিনিয়োগ ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল, নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ম্যালেরিয়ার ওষুধের কারণে তা ভেস্তে যেতে বসেছে।
সিয়াটলে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন-এর ’দ্য ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন’ গত মাসে এক রিপোর্টে জানায়, আর্টেমিসিনিন রেজিস্ট্যান্ট ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট প্রথমে ২০০৬ সালে কম্বোডিয়াতে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তখন থেকে ম্যালেরিয়া রেজিস্ট্যান্ট প্যারাসাইট থাইল্যান্ড-মায়ানমার বর্ডার পর্যন্ত ৮শ’ কিলোমিটার বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপকে ’সাইলেন্ট কিলার’ বা নিরব ঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর লাখ লাখ লোক উচ্চ রক্তচাপে মৃত্যুবরণ করেন। উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুটো মরণঘাতী রোগ হল ‘হৃদরোগ’ ও ‘স্ট্রোক’। হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষ অকর্মণ্য হয়ে যান বা মৃত্যুবরণ করেন। প্রাকৃতিক উপায়ে অথবা লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে রোগীকে ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। ওষুধ যদি আসল ও গুণগতমানসম্পন্ন হয় তবে রোগী ওষুধ সেবন করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করবেন। আর ওষুধ যদি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের হয় তবে রোগীর কী অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখুন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সারা বিশ্বে, বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোতে অসংখ্য রক্তচাপের ওষুধ নকল হচ্ছে এবং ওষুধ সেবন করে অগণিত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও জীবন দিচ্ছেন।
ক্যান্সার প্রাণঘাতী রোগ। এ রোগ প্রতিকারে এখনও খুব বেশি কার্যকর ওষুধ আবিস্কৃত হয়নি। আর যেসব ওষুধ বাজারে প্রচলিত আছে সেগুলোর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অ্যাভাস্টিন একটি বহুল প্রচলিত ক্যান্সারের ওষুধ। অ্যাভাস্টিনের একটি মাত্র ভায়ালের দাম আড়াই হাজার ডলার (২ লাখ ৫ হাজার টাকা)। গত বছর এ ওষুধের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
ওষুধ নকলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শাস্তি হল জেল। নকল ওষুধ প্রস্তুতকারকেরা খুব অল্প সময়ে কয়েক মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে ফেলতে পারে। তাই ধরা পড়লে তাদের খুব বেশি হলে ৬ মাসের মতো জেলে থাকতে হয়। নকল ওষুধের জন্য ব্যবসায়ীদের যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য জিনিসের জন্য মাত্র ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ করতে হয়। অল্প খরচে এটা তো অনেক লাভজনক ব্যবসা।
এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, অসাধু নকলবাজ ব্যবসায়ীরা অ্যাভেস্টিনের নকল ভার্সন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের লাভজনক ব্যবসাটি হাতিয়ে নিয়েছে। নকল অ্যাভেস্টিন এখন যুক্তরাষ্টের বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে যার কারণে ক্যান্সারের রোগীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা ওসব ওষুধ বেশি নকল করে যেগুলো বিক্রির দিক থেকে শীর্ষস্থানীয়। ফাইজারের কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ লিপিটর (জেনেরিক: অ্যাটরভ্যাস্টেটিন) বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্লকবাস্টার ওষুধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও লিপিটরের নকল পাওয়া যায়। ২০০৭-২০০৮ সালে নকল হেপারিনের (যে ওষুধ রক্ত জমাট প্রতিহত করে) ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪৯ জন মৃত্যুবরণ করেন। এই নকল হেপারিন চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিল।
পরিসংখ্যান মোতাবেক বিশ্বের ১৫ শতাংশ ওষুধ নকল । এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে নকল ওষুধের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। অ্যাঙ্গোলায় নকল ওষুধের পরিমাণ মোট ওষুধের ৭০ শতাংশ। ২০০৫ সালে ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) এর হিসাব মতে, সারা বিশ্বে নকল ওষুধ বিক্রির পরিমাণ প্রায় দু’শ’ বিলিয়ন ডলার।
নকল ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশ ও জোন হল পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, ল্যাতিন আমেরিকা, পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের অনেকগুলো দেশ, আফ্রিকা এবং ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন। ওসব দেশে বেশি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদিত হয় যেসব দেশে ওষুধশিল্পে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার অভাব রয়েছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতির কারণে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ও পণ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। কারণ ওসব দেশগুলোতে ওষুধ ও ওষুধ শিল্পের ওপর সরকারের কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত আছে। চীনে ওষুধ ও খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ও নকলের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করার বিধান আছে।
ওষুধের অনলাইন বেচা-কেনা বিশ্বজুড়ে নকল ওষুধের ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব বোর্ড অব ফার্মেসি’এর মতে, ৯ হাজার ৬ শত অনলাইন ফার্মেসির মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ কোম্পানি গুণগতমানের শর্ত পূর্ণ করে। এসব ফার্মেসির অনেকগুলোই বিদেশি বলে এদের ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা অবৈধ। অনেক ওষুধের জন্য আবার প্রেসক্রিপশন লাগে না। এ সুযোগে অসংখ্য নকল ও ভেজাল ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে যায়।
আমি ওপরে উল্লেখ করেছি, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ কীভাবে নকল ওষুধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং জীবন দিচ্ছেন। এছাড়াও ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতি বছর নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের কারণে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রতিরোধে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো হল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, পেশেন্ট অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গবেষক, প্রস্তুতকারক, সিকিউরিটি কোম্পানি, লাইসেন্সপ্রাপ্ত অনলাইন ফার্মেসি এবং ইন্টারনেট টেকনোলজি কোম্পানি।
২০১০ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপীয় ট্রেড কমিশন ‘অ্যান্টি-কাউন্টারফিটিং ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ (নকলবিরোধী বাণিজ্য চুক্তি) সম্পাদনের কাজ সম্পন্ন করেছে। চুক্তিতে পেটেন্ট রুল সংরক্ষণ, নকল ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এই সমস্যা সমাধানে বৃহত্তর সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন করার বিধান রাখা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি সম্পাদনে অংশগ্রহণ করে। চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নকল ওষুধের দৌরাত্ম বহুলাংশে কমে যাবে।
তবে নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রতিরোধ এত সহজ হবে না, বিশেষ করে অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে। কারণ এসব দেশে মাথাপিছু আয় নগণ্য হওয়ার কারণে দামি ওষুধ কেনার সামর্থ না থাকায় মানুষ সস্তায় ওষুধ পেতে চাইবে। ওষুধের দাম বেশি হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল ওষুধ উৎপাদনে ও বিক্রয়ে বেশি উৎসাহী হয়। এ ফর্মুলা ওষুধ কোম্পানিগুলোর ক্ষতির পরিমাণ বাড়ায়। বাংলাদেশে সম্প্রতি অসংখ্য ওষুধের দাম দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সুযোগ দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা গ্রহণ করবে, এতে সন্দেহ নেই।
কয়েক দিন আগে পত্রিকায় ‘মিটফোর্ডের অবৈধ মার্কেটে, কাঁচামালের জোগান দিচ্ছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পড়লাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওষুধ উৎপাদনের নাম করে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি কাঁচামাল কিনে নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে খোলাবাজারে কাঁচামাল বিক্রি হয়ে এলেও রহস্যজনক কারণে তারা এই অবৈধ বেচাকেনা বন্ধ করে না।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কারিগরি উন্নয়নের ফলে আজকাল আসল আর নকল ওষুধের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শুধু জানা যায় কোনটা আসল আর কোনটা নকল। তারপরও কিছু চিহ্ন আর বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নকল ওষুধ চেনা যায়। নকল ওষুধের অদ্ভুত ধরনের গন্ধ, স্বাদ ও রঙ থাকে। এটা অতি সহজে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো বা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ওষুধের প্যাকেটের গুণগতমান তেমন ভালো হয় না। লেবেলে নির্দেশনায় ভুল বানানের শব্দ থাকে এবং নির্দেশনায়ও ভুল থাকতে পারে। নকল ওষুধের দামও অত্যন্ত কম হয়। আসল ওষুধের দামের সঙ্গে তুলনা করলে একই নকল ওষুধের দামের তারতম্য ওষুধের গুণগতমান সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।
নকল ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার কিছু উপায় আছে, যেগুলো অবলম্বন করলে এর দৌরাত্ম থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে।
এক, আপনার পরিচিত দোকান থেকে ওষুধ কিনুন, যে দোকান বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত।
দুই, অনলাইনে ওষুধ কেনায় সাবধান হোন। ভেরিফাইড ইন্টারনেট ফার্মেসি প্র্যাকটিস সাইট (ঠওচচঝ) সিলযুক্ত ওয়েবসাইট দেখে কিনুন। অনলাইন ফার্মেসিগুলো বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত না হলে ওগুলো থেকে ওষুধ কিনবেন না। অন্তত ১৫টি ফার্মেসির ঠওচচঝ রয়েছে।
তিন, ওষুধ কেনার পর প্যাকেট ভালো করে পরীক্ষা করুন। নকল ওষুধ হলে প্যাকেটে কোনো না কোনো ভুল বা ত্রুটি ধরা পড়বে। প্যাকেটের ভিতর যে লিফলেটে রয়েছে তাও ভালো করে পড়ে দেখুন। সেখানেও অসংখ্য ভুল থাকতে পারে। ওষুধটি ভালো করে পরীক্ষা করুন। আসল ও নকল ওষুধের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। সন্দেহ হলে ঐ দোকান থেকে ওষুধ কিনবেন না।
চার, বিদেশ ভ্রমণকালে আপনার সব ওষুধ সঙ্গে নিন। পথে-ঘাটে ওষুধ কিনবেন না। অচেনা অজানা জায়গায় ও দোকানে ওষুধ কিনলে তা নকল হতে পারে।
ভেজালের রাজত্বে যখন বাস করছি আপাতত নিজেদের এইটুকু সাবধানতা জরুরি।
ড. মুনীরুদ্দিন আহমদ: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্র: বিডি নিউজ।