বিএনপির তৃণমূল উজ্জীবিত, নিষ্প্রাণ কেন্দ্র
সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনসমর্থন আদায়ে খালেদা জিয়ার জেলা সফর কর্মসূচি ও জনসভাকে কেন্দ্র করে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত ও সমন্বয়ের অভাবে দলটির কেন্দ্রের নেতাকর্মীরা অনেকটাই নিস্তেজ ও নিস্প্রভ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকেই আবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।
৫ জানুয়ারি নিবার্চনের পর খালেদা জিয়া জনসমর্থন আদায়ে রাজবাড়ী, জামালপুর, মুন্সীগঞ্জ, জয়পুরহাট, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, নীলফামারী, নাটোরে জনসভা করেছেন। আগামী ১২ নভেম্বর কিশোরগঞ্জে জনসভা করবেন তিনি। এ ছাড়া ২৯ নভেম্বর কুমিল্লায় জনসভা করার কথা রয়েছে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খালেদা জিয়ার জনসভাকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হয়রানি উপেক্ষা করে দলীয় প্রধানের কর্মসূচি সফল করতে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন। শুধু জনসভাই নয়, আন্দোলন কর্মর্সূচিও পালন করছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
খালেদা জিয়ার জেলা সফরে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হচ্ছে— এ কথা স্বীকার করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার জনসভাকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যেখানেই জনসভা করতে যাচ্ছেন, সেখানেই জনতার ঢল নেমে আসছে। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছে।’
তবে আন্দোলন কর্মসূচিতে কেন্দ্র ব্যর্থ নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেয় না। অনুমতি দিলে দেখা যাবে রাজধানীর সমাবেশও লোকেলোকারণ্য হয়ে যাবে। বিগত দিনে রাজধানীর সমাবেশে ব্যাপক লোক সমাগম ছিল।’
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জেলা পর্যায়ে খালেদা জিয়ার জনসভায় ব্যাপক লোকসমাগম দেখা যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারি নিবার্চনের পর ঢাকার বাইরে খালেদা জিয়া প্রথম সমাবেশ করেন ১ মার্চ রাজবাড়ীতে। ওই সমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগম ঘটে। এ ছাড়া ২৮ মে মুন্সীগঞ্জ, ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ২৭ সেপ্টেম্বর জামালপুর, ২২ জুন জয়পুরহাটে সমাবেশ করেন তিনি। ঢাকার বাইরে খালেদা জিয়ার প্রায় সবকটি সমাবেশে একই চিত্র দেখা গেছে। গত ২৩ অক্টোবর নীলফামারীর সমাবেশে পুরো রংপুর বিভাগের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। তাদের হাতে শোভা পায় জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ছবি সংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন ও প্লাকার্ড। সর্বশেষ ১ নভেম্বর নাটোরে খালেদা জিয়ার সমাবেশে বিপুল লোকসমাগম হয়।
সমাবেশে কেন্দ্রের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিএনপির স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তিনি বলেন, ‘আমরা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম, ঢাকায় সেইভাবে আন্দোলন হয়নি। ম্যাডাম আমরা বলতে চাই, এবার যদি ঢাকা ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা নাটোর থেকে গিয়ে ঢাকার নেতাদের ঘেরাও করবো। আপনি (ম্যাডাম) অনুমতি দিলেই তা হবে।’ ওই সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত ভাব সম্পর্কে জামালপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম দ্য রিপোর্টকে বলেন, আমরা সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ আছি। নেত্রী আসার পর থেকে নেতাকর্মীরা বেশ উজ্জীবিত। সবাই কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আমরা সব সময় রাজনৈতিক কর্মসূচি সক্রিয়ভাবে পালন করি। দেশনেত্রী (খালেদা জিয়া) জামালপুর সফরে তা প্রমাণ হয়েছে। জনসভায় নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে রবিবারের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগরীর নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তুলনামুলক কম।
রাজধানীর উত্তরা, তুরাগ, পল্লবী, রূপনগর, শাহজাহানপুর, মতিঝিল, বাড্ডা, ওয়ারী, গেন্ডারিয়া, শাহআলী, তেজগাঁও, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, মিরপুর, কলাবাগান, ডেমরা, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, শ্যামপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর বিএনপির এক নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা মিছিল বের করেছি। পুলিশ আমাদের মিছিলে বাধা দিয়েছে। আমাদের মিছিলে বেশ কয়েক জন আহত হয়েছেন।’
কর্মসূচি কতটা সফলভাবে পালন হয়েছে এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজকে (রবিবার) আদালতে ম্যাডামের হাজিরা ছিল, সেখানে অনেকই গিয়েছিল। যে কারণে অনেকটা দায়সারাভাবে রাজধানীতে কর্মসূচি পালিত হয়েছে।’
ঢাকা মহানগরী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ জানুয়ারি নিবার্চনের পর প্রথম হরতালে ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন নিস্প্রভ। রাজপথে নামতে পারেননি তারা। বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়ার প্রতিবাদে ২০ দলীয় জোটের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ছিল দায়সারা। ওই দিন ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য হাবিব উন নবী খান সোহেল ছাড়া কেন্দ্রের কোনো নেতাকেই রাজপথে দেখা যায়নি। ওইদিন সোহেল গুটি কয়েক কর্মী নিয়ে রাজধানীর বেইলি রোডে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করেন। রবিবারের কর্মসূচিটিও দায়সারাভাবে পালন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীতে সাংগঠনিক কোনো দুর্বলতা, সমন্বয়হীনতা নেই। সরকার আমাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচিগুলো করতে দিচ্ছে না। আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে সরকারের বাধা কীভাবে অতিক্রম করা যায়।’
রাজধানীতে নেতাকর্মীদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ সম্পর্কে বিএনপির এ নীতিনির্ধারক বলেন, ‘আজকের ঢাকা শহরের বেশ কয়েকটি এলাকা আমি মনিটরিং করেছি। সেখানে আমাদের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে। নেতাকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিছিল বের করেছে। জোর করে মিছিল করা যায়, কিন্তু সমাবেশ তো আর জোর করে করা যায় না। ’
এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শনিবার দুপুরে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় বিএনপি সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি দিয়েছে। আমি এ কর্মসূচির সঙ্গে একমত নই। কারণ যে বিপ্লব ও সংহতি দিবসের মাধ্যমে বিএনপির জন্ম, আর সেই দিনটি পালন করতে দেয়নি অবৈধ সরকার। এ জন্য হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দেওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘৭ নভেম্বর পালন করতে দিচ্ছেন না শেখ হাসিনা। এর প্রতিবাদে ঢাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে শুক্রবারই বিক্ষোভ মিছিল করা উচিত ছিল। ঢাকায় কমিটির পদ নিয়ে তো ভালই লড়াই দেখেছি। কিন্তু এ কমিটি কি করল? তারাও ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তাই এ কর্মসূচির চেয়ে কঠোর কর্মসূচি দিলে আমরা নারায়ণগঞ্জ বিএনপি কঠোরভাবে রাজপথে নামতে প্রস্তত।’