জাতীয় স্মৃতি সৌধ; কীর্তিতেই বেঁচে থাকবেন মইনুল হাসান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য ত্যাগ ও শৌর্যের স্মৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় স্মৃতি সৌধ। সৌধটি ঢাকা থেকে ৩৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে সাভারে অবস্থিত। এর স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেন। রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সোমবার দুপুর আড়াইটায় তার মৃত্যু হয়। তার কীর্তিতেই বেঁচে থাকবেন তিনি।
১৯৭৮ সালে সৌধ নির্মাণের উদ্দেশ্যে নকশার জন্য একটি জাতীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সাতান্ন জন প্রতিযোগীর মধ্য থেকে স্থপতি মইনুল হোসেনের নকশাটি নির্বাচিত হয়।
অসমান উচ্চতা ও স্বতন্ত্র ভিত্তির ওপর সাতটি ত্রিভুজাকৃতির প্রাচীর নিয়ে মূল সৌধটি গঠিত। সর্বোচ্চ স্তম্ভটি সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যের ভিত্তির ওপর, আর সর্ব দীর্ঘ ভিত্তির ওপর স্থাপিত স্তম্ভটি সবচেয়ে কম উচ্চতার। প্রাচিরগুলো মাঝখানে একটি ভাঁজ দ্বারা কোণাকৃতির এবং একটির পর একটি সারিবদ্ধভাবে বসানো। কাঠামোটির সর্বোচ্চ বিন্দু বা শীর্ষ ৪৫.৭২ মিটার উঁচু। কাঠামোটি এমনভাবে বিন্যস্ত যে, ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে একে ভিন্ন ভিন্ন অবকাঠামোয় পরিদৃষ্ট হয়।
স্থপতি মূল স্তম্ভটি নির্মাণে মইনুল হোসেন সিমেন্ট-পাথরের কংক্রিট ব্যবহার করলেও এর সংলগ্ন অন্যান্য অবকাঠোমো ও পেভমেন্ট নির্মাণে লাল ইট ব্যবহার করেছেন। ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের ব্যবহার মূল স্তম্ভটির গাম্ভীর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
সমগ্র কমপ্লেক্সটি ৩৪ হেক্টর (৮৪ একর) জমি জুড়ে বিস্তৃত। একে ঘিরে আছে আরও ১০ হেক্টর (২৪.৭ একর) সবুজ ভূমি। স্তম্ভটির সামনে বেশ কয়েকটি গণকবর ও একটি প্রতিফলন সৃষ্টিকারী জলাশয় নির্মিত হয়েছে।
প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ করলে স্তম্ভটিকে প্রবেশদ্বারের অক্ষবরাবরই চোখে পড়ে। কিন্তু মূল বেদীতে পৌঁছাতে হলে বেশ কিছু উঁচু নিচু এলাকা, পেভমেন্ট ও একটি কৃত্রিম লেকের উপর নির্মিত সেতু পার হতে হয় এ সব কিছুই স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামকে চিহ্নিত করছে।
প্রকল্পটি তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম পর্যায় শুরু হয় ১৯৭২ সালে। ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এ পর্যায়টিতে ভূমি সংগ্রহ ও প্রকল্পের রাস্তা নির্মাণ করা হয়।
১৯৭৪-১৯৮২ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে গণ-কবর, হেলিপ্যাড, পার্কিংয়ের জায়গা, পেভমেন্ট প্রভৃতি নির্মাণে ব্যয় হয় ৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
১৯৮২ সালের আগস্টে সম্পন্ন তৃতীয় পর্যায়ে কৃত্রিম লেক, পাশের সবুজ অঙ্গন, ক্যাফেটারিয়া, হাউজিং প্রভৃতি ছাড়াও মূল স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ব্যয় হয় ৮৪৮.৬৫ লক্ষ টাকা। নির্মাণ তত্ত্বাবধান করেছে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ। তথ্য সূত্র :বাংলাপিডিয়া
প্রসঙ্গত, ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সৈয়দ মইনুল হোসেন ৩৮টি বড় বড় স্থাপনার নকশা করেন। এর মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, IRDP ভবন কাওরানবাজার, ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন, চট্টগ্রাম ইপিজেড, বাংলাদেশ চামড়াজাত প্রযুক্তির কর্মশালা ভবন, উত্তরা মডেল টাউন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদামের নকশা, কফিল উদ্দিন প্লাজা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ভবন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের নকশা করেছেন তিনি।
এরপর অবসর জীবনে চলে যান তিনি। অনেকটা নিভৃতে জীবনযাপন করছিলেন। মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই তিনি মানসিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভোগছিলেন। গত রবিবার অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার একদিন পরই মারা গেলেন তিনি।