ছিনতাইয়ের ঘটনায় ওলটপালট ডাক্তার দম্পতির জীবন
একটা ছিনতাইয়ের ঘটনা ওলটপালট করে দিলো নববিবাহিত ডাক্তার দম্পতি মুনতাহিদ আহসান-সানজানা জেরিনের সুখের জীবন। ঘটনার পর থেকে দুই মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখনো অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই জেরিনের। জেরিন এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।
জেরিনের এমন অবস্থায় বিধ্বস্ত তার স্বামী ডাক্তার মুনতাহিদ আহসানও। বলছিলেন,‘ভেবেছিলাম একটু থিতু হয়ে জীবনটাকে উপভোগ করব। বিয়ের বয়স এক বছর পাঁচ মাস। হানিমুনে যাওয়া হয়নি। টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। কোথায় যাব, তা নিয়ে চলছিল আলাপ-আলোচনা। তবে দেশের বাইরে যাব বলে ঠিক করেছিলাম। হানিমুনের সেই টাকা দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করেছি।’ এ কথা বলার সময় গভীর হতাশা ফুটে ওঠে চিকিৎসক মুনতাহিদ আহসানের মধ্যে।
কি ঘটেছিলো সেদিন:
সেদিন ভোর ছয়টার দিকে রিকশায় করে স্বামীর সঙ্গে জেরিন তাঁর কর্মস্থল ফেনীর পরশুরামে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। রাজধানীর কমলাপুর ফুটবল স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সাদা রঙের একটি ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে জেরিনের হাতব্যাগে হেঁচকা টান দেওয়া হয়। এতে জেরিন ১০-১৫ ফিট দূরে গিয়ে পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান।
মুনতাহিদের ভাষ্য, ‘আমার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা, আমার মাথার সিটিস্ক্যান করাও’—এ কথা বলেই জ্ঞান হারান জেরিন। এটাই ছিল জেরিনের মুখ থেকে শোনা শেষ কথা। এরপর থেকে তিনি নির্বাক, নিথর। জেরিনের মাথায় এর মধ্যে দুবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। কিন্তু এতে কোনো লাভ হয়নি।
জেরিন এখনো চোখ মেলে তাঁর প্রিয়জনদের দেখেন বটে, কিন্তু সেই চোখের কোনো ভাষা নেই। এক মাস লাইফ সাপোর্টে ছিলেন জেরিন। এখন অবশ্য সে ব্যবস্থা খুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জেরিনের যন্ত্রণা কমেনি। মাঝেমধ্যে তাঁর এতটাই জ্বর ওঠে, ছটফট শুরু করেন জেরিন।
বিএসএমএমইউর অ্যানেসথেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল হাই বলেন, ‘মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত পাওয়া এমন রোগীর সুস্থতার বিষয়ে কিছুই বলা যায় না। রোগীকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে সুস্থ মনে হলেও ভালো বলার উপায় নেই। আবার অসুস্থ মনে হওয়ার পরও অনেকে সুস্থ হন। এমন পরিস্থিতিতে এক রোগীর ৪২ বছর বেঁচে থাকার নজিরও আছে। আমরা চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। কত দিন চিকিৎসা চালাতে হবে, তা বলাও সম্ভব নয়।’
৩৩তম বিসিএস উত্তীর্ণ এ এই দম্পতি চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ঘটনার দিনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক সংশোধিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী জেরিনকে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ করা হয়। মুনতাহিদকে ফেনীতে নিয়োগ করা হয়।
ঘটনার পর মুনতাহিদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর স্বামী ও স্ত্রীকে একই জায়গায় দিতে আবেদন করেন।
ঘটনার পর জেরিনকে প্রথমে আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সে ভর্তি করা হয়। পরে নেওয়া হয় কাকরাইলের ইসলামিয়া ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে। তারপর বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়। আবেদন করার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিশেষ বিবেচনায় আইসিইউর ভাড়া নিচ্ছে না। এর পরও এ পর্যন্ত জেরিনের চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়ে গেছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। প্রতিদিনই ওষুধসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
মুনতাহিদ ও জেরিনের দুজনের পরিবারই মধ্যবিত্ত। এই দম্পতি পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। তাঁরা ছিলেন একই ব্যাচের শিক্ষার্থী। সেখানকার শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরাই জেরিনের চিকিৎসার জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরাই বা আর কত দেবেন? মুনতাহিদ বুঝতে পারছেন না স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ আর কত দিন চালাতে পারবেন।
মুনতাহিদ বলেন, ‘জেরিন মাত্র ১০ বছর বয়সে তার মাকে হারায়। ছেলেমেয়ের সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করে বাবা আর বিয়ে করেননি। জেরিনের চাহিদা খুবই কম। সময়ের কাজ সময়ে করতে ভালোবাসে। গোছানো জীবনে অভ্যস্ত। আমার অগোছালো জীবনটাকেও গোছাতে চেয়েছিল। তবে সেই মেয়ের জীবনটাই এখন অগোছালো হয়ে গেল।’
জেরিনের বাবার স্বপ্ন ছিল একটাই—তা হলো জেরিন চিকিৎসক হয়ে মানুষকে সেবা করবেন। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করা জেরিনের বাবার সেই আশা পূরণ করতে চলেছিলেন। কিন্তু শুধু একটি ঘটনায় সব শেষ হতে চলেছে।
ঘটনার পর মুগদা থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি উল্লেখ করে মামলা করেছেন মুনতাহিদ। থানা থেকে সন্দেহভাজন ধরে মুনতাহিদকে ফোন দেওয়া হয়। মুনতাহিদ বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি শুধু একটি হাত দেখেছি। তা দেখে তো আর কাউকে দোষী বলা যায় না।’
মুনতাহিদ বলেন, ‘মাত্র কয়েকদিন আগে রাজধানীতে আরেকজন নারী ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মারাই গেলেন। আমার স্ত্রী মারা যাননি তফাৎ শুধু এইটুকু। নগরীর কোন কোন জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তা পুলিশ প্রশাসন জানে। তারা একটু তৎপর হলেই আমাদের আর এ ধরনের ঘটনার শিকার হতে হয় না। এখন ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা তো দূরের কথা, স্ত্রী বাঁচবে কি না, এটাই তো অনিশ্চিত।’
ছিনতাইকারীদের উদ্দেশে মুনতাহিদ বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা কী মানুষ না?’
জেরিনের সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসতে চাইলে মোহাম্মদ মুনতাহিদ আহসান ভূঞা, ব্র্যাক ব্যাংক, মতিঝিল শাখা, হিসাব নম্বর-১৫১৩২০২৫০৬৬৮১০০১ এই ঠিকানায় আর্থিক সহায়তা করতে পারেন।