অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছাত্রীর শ্লীলতাহানি
ব্যাঙ্গালুরুর পর এবার স্কুলে ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনা কলকাতাতে। ঘটনাটি ঘটে গত সোমবার অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল জিডি বিড়লা সেন্টার ফর এডুকেশনে। ঘটনার এক সপ্তাহ কেটে গেলেও স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এদিন স্কুলের বাইরে বিক্ষোভ দেখান অভিভাবকরা।
এই অভিভাবকদের জমায়েত, বিক্ষোভ, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চিত্কার আরও একবার মনে করিয়ে দিল গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে দমদমের ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনাকে।
বিক্ষোভরত অভিভাবকেরা জানাচ্ছেন, চার বছর অন্তর এই গ্রুপের তিনটি স্কুল মিলিয়ে (জিডি বিড়লা, মহাদেবী বিড়লা শিশুবিহার এবং অশোক হল) একটি ফেস্ট করা হয়। জানুয়ারিতে সেটি হওয়ার কথা। স্পেকট্রাম নামে ওই ফেস্টের জন্য ছাত্রীদের মহড়া চলছে। গত সোমবার অর্থাত্ ৩ তারিখ রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের উল্টোদিকে বিবেকানন্দ পার্কে এ রকমই একটি মহড়ায় ছাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেই সময় লোয়ার ইনফ্যান্ট ক্লাসের এক ছাত্রী টয়লেটে যেতে চায়। অভিযোগ, সে সময় ওই ছাত্রীদের দেখভাল করার জন্য যে পরিচারিকা ছিলেন, তিনি এক বাস ড্রাইভারকে বলেন ছাত্রীটিকে টয়লেটে নিয়ে যেতে। সেখানেই ওই ড্রাইভার ছাত্রীটির সঙ্গে অশালীন আচরণ করে বলে অভিযোগ। ছাত্রীর চিত্কার শুনে স্কুলেরই এক শিক্ষিকা ছুটে আসেন। ওই শিক্ষিকাই ছাত্রীটিকে উদ্ধার করেন। সকলকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা হয়। স্কুল-কর্তৃপক্ষ ফোন করে ওই নিগৃহীতা শিশুটির বাবা-মাকে খবর দেন।
এই ঘটনা আরও একবার সামনে এনে দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রী নিরাপত্তার ঢিলেঢালা ব্যবস্থাকে। গত কয়েক মাসে একের পর এক শিশুছাত্রী নিগ্রহের ঘটনায় উত্তাল বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন স্কুল। তিনটি ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে গিয়েছে। জিডি বিড়লার অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুল-কর্তৃপক্ষ সব জেনেশুনেও নিজেদের সুনাম বজায় রাখতে ঘটনাটি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বেঙ্গালুরুর মতো এ দিনও কলকাতার এই স্কুলে সকাল থেকে গোটা দিন বিক্ষোভে সামিল হন অভিভাবকেরা। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘খোঁজ নিয়েছি। রিপোর্ট দিতে বলেছি। কলকাতার বুকে এমন ঘটনা ঘটলে উদ্বিগ্ন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।’ স্কুল-কর্তৃপক্ষ অবশ্য একটি প্রেস বিবৃতিতে দাবি করেছে, ‘এই অভিযোগকে আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখেছি। সঙ্গে সঙ্গে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই ছাত্রীর বাবা-মার সামনেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের এনে একটি টিআই প্যারেড করা হয়েছিল।’ এ দিনই তদন্তে যায় রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের একটি দল।
ওই স্কুলের অভিভাবক রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘আমরা শুনেছি স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল শর্মিলা নাথ ওই শিশুটির বাবা-মাকে বলেন যে তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবেন, তাই পুলিশ বা মিডিয়ার কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অন্য ছাত্রীদের মারফত এই কথাটা আমরা ঘটনার কয়েক দিন পরে জানতে পারি। স্কুল কী তদন্ত করছে সেটা দেখার জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ বাদেও যখন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি দেখে আমরা জমায়েত করেছি।’
যদিও প্রেস বিবৃতিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ নিগৃহীতা ছাত্রীর বাবা-মায়ের লেখা একটি চিঠির অংশ উদ্ধৃত করেছে। যেখানে আবার ঘটনাটি স্কুলের মধ্যেই ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, স্কুলের তরফে ছাত্রীদের দেখভালের দায়িত্বরত তিনজন আয়া এবং ২ জন জমাদারকে ওই ছাত্রী ও তার বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে সনাক্ত করণের জন্য ডাকা হয়েছিল। মেয়েটি সকলের দিকেই আঙুল তোলে। ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তাই কাউকেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। যে দুই জমাদারকে ডাকা হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন লাল শার্ট পরে এসেছিলেন৷ যা দেখে বাচ্চাটি ভয় পায়। সে আমাদের কাছে ‘লাল’ শব্দটি উল্লেখ করেছিল। তাই সেই জমাদারকে সাময়িক ভাবে কাজে আসতে বারণ করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এরপরও অভিযোগ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। কারণ বাসের মধ্যে থাকা যে ‘খারাপ লোক’-এর কথা বাচ্চাটি বলছে, এই জমাদার সে নয়৷’ ওই চিঠিতেই স্কুলের সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছেন নিগৃহীতার বাবা-মা।
বিক্ষোভ চলাকালীন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল অবশ্য একবারের জন্যও প্রকাশ্যে কোনও বিবৃতি দিতে আসেননি। স্কুল-কর্তৃপক্ষের দাবি, তিনি অসুস্থ। ছুটিতে আছেন৷ সকাল ন’টা থেকে চলা এই বিক্ষোভের খবর পেয়ে স্কুলের তরফে প্রথম কথা বলতে আসেন ভাইস প্রিন্সিপ্যাল বিজয়া ভরদ্বাজ৷ প্রথমে তিনি সুর চড়িয়ে দাবি করতে থাকেন, ‘কিছু হয়নি। আপনারা কী করে জানলেন? একেবারে বাজে কথা। কী প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে?’ কিন্তু বেলা যত বাড়তে থাকে ততই অভিভাবকদেরও ক্ষোভ চরমে উঠতে থাকে। একেবারে ক্রাইস্ট চার্চের মতো কিছু অভিভাবক মারমুখো হয়ে ওঠেন। স্কুল ঘিরে ফেলে যাদবপুর থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী। ঘটনাস্থলে পৌঁছন ডিসি (এসএসডি) সন্তোষ পাণ্ডের নেতৃত্বে কমব্যাট ফোর্সও। যদিও তাঁরা স্কুলের বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন। ভিতরে ছিল সাধারণ পুলিশ কর্মীরা। বেগতিক বুঝে ভাইস প্রিন্সিপ্যালকে আরও একবার অভিভাবকদের ‘অ্যাড্রেস’ করার পরমার্শ দেন সন্তোষ পাণ্ডে।
তথ্যসূত্র: এই সময়