‘বেশি অত্যাচার হলে ঢাল-তলোয়ার’ কিশোরগঞ্জ সমাবেশে খালেদা জিয়া
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারকে নব্য মীর জাফর আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘ঈশা খাঁর কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। বেশি অত্যাচার হলে ঢাল-তলোয়ার আছে, এটা নিয়েই মোকাবিলা করব।’
কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ মাঠে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় বুধবার বিকেলে খালেদা জিয়া এ সব কথা বলেন। প্রায় ১ ঘণ্টার বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া। জেলা বিএনপি সিনিয়র সহ-সভাপতি শরিফুল আলম সভাপতিত্ব করেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা। দেশের মানুষ আর এই সরকারকে চায় না। তারা জানে ক্ষমতা থেকে নামলে জনগণ তাড়া করবে, আস্ত রাখবে না। এরশাদের চেয়েও দুরাবস্থা হবে এদের।’
তিনি বলেন, ‘সময় মতো আন্দোলনের ডাক দিব। তখন দেখতে পারবেন পরিবর্তন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিবার্চন হলে আওয়ামী লীগ ১০টা ভোটও পাবে না। এই নব্য মীর জাফরকে বিদায় করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করব।
তাদের শান্তি মিশনে নেবেন না : র্যাব এবং পুলিশকে ট্রেনিং, গোলাবারুদ, রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস না দেওয়ার জন্য সরবরাহকারী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে খালেদা বলেন, ‘বাংলাদেশের জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে গোলাবারুদ, রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করা হয় না। এগুলো দিয়ে নিরীহ যুবকদের হত্যা করা হচ্ছে, পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ জনগণের ওপরে দমন পীড়ন করা হচ্ছে। তাই আমি বিদেশীদের কাছে অনুরোধ করব আপনারা এগুলো দিবেন না। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও আমরা রিপোর্ট পাঠাবো। আপনারা এগুলো বিদেশীদের কাছে পাঠাবেন।
জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘র্যাবে যারা আছে, তাদের শান্তি মিশনে নিবেন না। যাতে তারা শান্তিু মিশনে না যেতে পারে সেই ব্যবস্থা করবেন। কারণ বিদেশে গিয়েও তারা এ সব কাজ করতে পারে। ফলে দেশে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।’ এ সময় তিনি আবারো র্যাব বাতিলের দাবি জানান।
গুমের প্রতিষ্ঠান র্যাব : বিএনপি প্রধান বলেন, ‘পুলিশ দুর্নীতি করছে। র্যাব কত মানুষকে হত্যা করেছে। নারায়ণগঞ্জে ৭ জন নয়, ১১ জনকে খুন করেছে। মাঝিদেরকে তারা খুন করেছে। র্যাব মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইয়ং ছেলেদের ধরে নিয়ে খুন করছে। আমাদের দলের ৩১০ জন খুন করেছে, ৫৬ জনকে গুম করেছে। ইলিয়াস আলীকে তার বাড়ি কাছ থেকে র্যাব গুম করে নিয়ে গেছে। লাকসামে আমাদের নেতা হিরু ও আরেকজনকে নিয়ে গেছে। হাসিনাকে জানানো হয়েছে তবুও তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি। মানুষ হত্যা, গুমের প্রতিষ্ঠান এখন র্যাব। এই র্যাব বাতিল করতে হবে। এ সময় খালেদা জিয়া, সমাবেত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, র্যাব কী বাতিল করা উচিৎ? সঙ্গে সঙ্গে পুরো মাঠ কাঁপিয়ে নিনাদ ধ্বনিত হয়, চাই, চাই।
তিনি বলেন, ‘পুলিশ এখন জনগণের সেবক নয়। তারা টাকার বিনিময়ে মানুষ খন করে, জেল দেয়, আবার ছুটায়। টাকা না দিয়ে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়। ডিবিকে ব্যবহার করা হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক হত্যাকান্ডে। আর এটা করলেই এ অবৈধ সরকার তাদের পদোন্নতি দেয়।’
পুলিশের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। হত্যা নির্যাতন আপনাদের কাজ নয়। আপনারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করুন। ’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘চন্দ্রাবতীর স্মৃতি বিজড়িত এই কিশোরগঞ্জ ২০১৩ সালের আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকার রেখেছে। দেশে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। ৫ জানুয়ারি নিবার্চনে জনগণ ভোট দেয়নি। মানুষ ছিল না ভোটকেন্দ্রে, ছিল কুকুর। তাহলে কী করে তারা নির্বাচিত সরকার দাবি করে। এরা জনগণের না, এই কিশোরগঞ্জে অনেক বড় বড় মানুষের জন্ম হয়েছে। আমরা এখানে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করে ছিলাম। আর এখন দেখেন কী অবস্থা? রাস্তা দিয়ে এলে হাড়গোড় ভেঙে যায়। কিশোরগঞ্জে দুই জন রাষ্ট্রপতি। তাদের ছেলেরা এমপি। মন্ত্রী আছেন। কিন্তু কিশোরগঞ্জে উন্নয়ন হয়নি।’
খালেদা জিয়া অর্থনীতির দুরাবস্থার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘এখন অর্থমন্ত্রী বলে দুর্নীতি করা নাকি অপরাধ নয়, ঘুষ নেওয়া নাকি অপরাধ নয়। এ সরকার দুর্নীতিকে বৈধতা দিয়েছে। দুদক দুর্নীতি মুক্তির সার্টিফিকেট বিতরণ করছে। দুদক এখন দুর্নীতি কমিশন, এটা দুর্নীতির আখড়া।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বজিৎ বলেছিল আমি হিন্দু আমাকে মেরো না। আমি কোনো দল করি না। আমি দর্জির দোকানি। ক্ষমতায় এলে বিশ্বজিৎ পরিবারের সদস্যদের চাকরি দেব।’
আওয়ামী লীগের লোকদের সম্পদ বেড়েছে : খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশের দুরাবস্থা কিন্তু আওয়ামী লীগের অবস্থা খুব ভালো। তারা নিজেদের অনেক উন্নতি করে ফেলেছে। কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের লোকেদের সম্পদ কয়েক শত গুণ বেড়েছে। পদ্ম সেতুর দুর্নীতির বিচার চলছে বিদেশে আর দুদক দায় মুক্তি দিয়েছে। শেখ হাসিনার ভাষায়- এই দুর্নীতিবাজরা দেশ প্রেমিক। ৩৮ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে তারা। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে বিচারকদেরও যেতে হবে, জবাবদিহি করতে হবে
বিচার বিভাগ স্বাধীন নয় : বিচার বিভাগ স্বাধীন নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিচার বিভাগে দুই রকম বিচার চলছে। বিরোধীদলকে জেলে পুরে দেয়। বিচারপতিরা চাকরি বাঁচাতে সঠিক রায় দিতে পারে না। শেখ হাসিনার নামে ১৫টি মামলা ছিল। আর আমার নামে ৫টি মামলা দিয়েছিল ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন। তাদের ৮ হাজার মামলা প্রত্যাহার করেছে। বিচারকদের বলব আমাদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুন। ভয় নেই। আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করব।
তিনি বলেন, ‘সবাই এক আল্লাহ বিশ্বাস করেন। প্রথমে তার কাছে বিচার চাইবো। তিনি সব সময় বিচার করেন। মানুষে বিচারদের আল্লাহর পড়ে সম্মান করেন। আল্লাহর কাছে বিচারকদেরও যেতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে। হাশরের ময়দানে আপনাদেরও বিচার হবে।’
খালেদা জিয়া বলেন , আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিলে প্রতিরোধ ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। আমি যখন ডাক দিবো আমার ডাকে সাড়া দিবেন। এই সরকারকে বিদায় করা হবে। আপনারা আমাকে তিন বার প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব আমার কাছে বড় নয়, এদেশ, দেশের মানুষ আমার কাছে বড়। আমি জনগণের সঙ্গে থাকতে চাই।
ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীন আমাকে বলেছিল তাদেরকে বৈধতা দিলে আমাকে ক্ষমতায় বসাবে।
এক-এগারোর কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীন বলে ছিল, দেশ থেকে চলে যান। আপনার এবং আপনার পরিবারকে কিছু বলা হবে না। আমি বলে ছিলাম, বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এদেশেই আমার সব। দেশের মানুষের সঙ্গেই থাকবে আমি। তাতে যে শাস্তি হয়, হবে। আমি এক বছর আটদিন জেলে ছিলাম। আরেক জন জীবনের ভয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিল। তিনি টাকার চেক নিয়েছিলেন। ঘুষ নিয়েছিলেন। তার স্বীকার করেছে তার ভাই এবং জলিল সাহেব। এই দুর্নীতি একদিন আমি দেখব। ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীন আমাকে বলেছিল তাদেরকে বৈধতা দিলে আমাকে ক্ষমতায় বসাবে। আমি বলেছিলাম তোমরা আমাকে ক্ষমতায় বসানোর কে? জনগণ আমাকে ক্ষমতায় বসাবে। সেই জন্য তারা আমাকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘শহীদ জিয়াকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। তার লাশ লুকিয়ে রেখেছিল। মানুষ সেই লাশ বের করে এনেছে। সিরাজদৌলা যেমন আছে, মীর জাফরেরও জন্ম হয়েছে এদেশে। মীর জাফররা শহীদ জিয়াকে হত্যা করেছে।’
উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারির নিবার্চনের পর খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের অধিনে নিবার্চনের দাবিতে রাজবাড়ী, জামালপুর, মুন্সীগঞ্জ, জয়পুরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নীলফামারী ও নাটোরে জনসভা করেছেন। এ ছাড়া ২৯ নভেম্বর কুমিল্লায় জনসভা করার কথা রয়েছে।
জনসভায় বক্তব্য যারা : বিএনপির নেতাদের মধ্যে- মির্জা ফখরুল, হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ড. ওসমান ফারুক, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসূফ, আমান উল্লাহ আমান, ফজলুল হক মিলন, নাজিম উদ্দিন আলম, আব্দুস সালাম প্রমুখ।
জোট নেতাদের মধ্যে- কর্লেল অলি অলি আহমদ, অধ্যাপক মজিবুর রহমান, মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক, শফিউল আলম প্রধান প্রমুখ।
স্থানীয় নেতাদের মধ্যে- জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান, বিএনপি নেতা ইসরাঈল মিয়া, রেজাউল করিম চুন্নু, খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল প্রমুখ।
পথে পথে খালেদাকে অভ্যার্থনা : খালেদা জিয়া সকালে ঢাকায় তার গুলশানের বাসভবন থেকে গাড়ি বহর নিয়ে কিশোরগঞ্জ পৌঁছানো অবধি সড়কে অভ্যার্থনায় সিক্ত হন। পথে স্থানে স্থানে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী স্লোগান এবং ফুল ছিটিয়ে তাকে অভিনন্দিত করে। জনসভা স্থল পর্যন্ত অন্তত ছয় শত বর্ণাঢ্য তোরণ ছিল।
যাত্রাবাড়ীতে সালাহ উদ্দিন আহমেদ, নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে কাজী মনিরুজ্জামান, নরসিংদীতে খায়রুল কবির খোকন, সরদার শাখাওয়াত হোসেন বকুল, শিরপুরে ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক আক্রামুল হাসান, কুলিয়ারচরে মেজর(অব.) আক্তারুজ্জামান খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
সার্কিট খালেদা জিয়াকে সংর্বধনা : খালেদা জিয়া বেলা ৩টায় কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউজে পৌঁছনোর সময় একটি হাতির পিঠে চড়ে রাজকীয় পোশাক পরিহিত একজন কাঠের তলোয়ার তুলে তাকে সালাম জানান। আর ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়া, মলুয়া ও সাখিনার বেশে তিন তরুণী খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দেন শুভেচ্ছার ফুল। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ জেলা নেতাদের প্রতিকৃতি সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন, প্লাকার্ড, পোস্টারে ছাওয়া ছিল পথমালা।
জনসভায় অংশ নিতে সকাল থেকেই জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে বিএনপি ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গুরুদয়াল কলেজ মাঠে আসতে শুরু করেন। দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার পথ বাস এবং অন্যন্য যান্ত্রিক যানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়া সর্বশেষ কিশোরগঞ্জ এসেছিলেন। ২০০৮ সালে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে ভৈরবে আসেন।
কিশোরগঞ্জের জনসভা শেষে খালেদা জিয়া বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছেন।