হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন বৃহস্পতিবার
মানুষ তাকে কতো ভালবাসে তা দেখার জন্য তিনি জন্মদিন উদযাপন করতেন। মানুষ আসতেন তার জন্মদিনে ফুল নিয়ে, কেউ বই নিয়ে কেউবা শূন্য হাতে। সারা দেশে চেনা-অচেনা মানুষের এমন আগমন দেখে তিনি জীবদ্দশায় বিস্মিত হয়েছিলেন। এই তিনি আর কেউ নন, বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার ও গীতিকার হুমায়ূন আহমেদ। বৃহস্পতিবার তার জন্মদিন। এমন দিনে তিনি সশরীরে বেঁচে নেই। এবারের জন্মদিনে তিনি নূহাশপল্লীতে, গভীরতম এক ঘুমে আচ্ছন্ন। আজও শিশিরভেজা ভোরে পাখিরা তাকে জানাবে অভিবাদন। হয়তো তিনি দেখবেন, হয়তোবা দেখবেন না।
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর মামাবাড়ি নেত্রকোণার মোহনগঞ্জে। যেদিনটিকে ঘিরে পুরো দেশের হুমায়ূন ভক্তদের মধ্যে সৃষ্টি হতো উন্মাদনা। আজ সেই দিন। বরাবরের মতো এবারও নানা আয়োজনে পালিত হবে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। কিন্তু তিনি তো নেই।
তবু মনে মানে না। তার লেখার মতো বলতে হয়, ‘পাখি উড়ে গেলেও পালক ফেলে যায় আর মানুষ চলে গেলে ফেলে রেখে যায় স্মৃতি।’ সেই স্মৃতিকে ধারণ করে বৃহস্পতিবার রাতে তার ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’ ফ্ল্যাটে কাটা হয়েছে কেক। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে কেক কেটেছেন। কিন্তু খাইয়ে দিতে পারেননি হুমায়ূন আহমেদকে। আনন্দের রোশনাইয়ের বদলে হয়েছে বেদনার বিষাদ সিন্ধু।
পাঠক বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। আর তিনি সাহিত্যের যে ক্ষেত্রেই নিজের পদচিহ্ন এঁকেছেন প্রত্যেকটিতেই দেখা পেয়েছেন সাফল্যের। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনকও বটে। ১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পর পরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। উপন্যাসে ও নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। বলা হয়, তাঁর লেখা পছন্দ করেন না এমন মানুষও তাঁর নতুন লেখাটি ‘গোপনে’ পড়ে ফেলেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা তাঁর অন্তত একটি নাটক দেখেনি কিংবা তাঁর কোনো বই পড়েনি। জনপ্রিয়তার জগতে তিনি একক ও অনন্য। তিনিই তরুণ-তরুণীদের করেছেন বইমুখী। প্রত্যেক বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় হুমায়ূন আহমেদের বই কিনতে হামলে পড়ে তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে এগারোটায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক। রচনা ও পরিচালনা করেছেন বহু একক ও ধারবাহিক নাটক। পরিচালনা করেছেন চলচ্চিত্রও। তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য তিনি লাভ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
হুমায়ূন আহমেদের দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্যজীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) ইত্যাদি। দেশের বাইরেও সম্মানিত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। জাপানের ‘এনএইচকে’ টেলিভিশন তাঁকে নিয়ে ‘হু ইস হু ইন এশিয়া’ শিরোনামে পনের মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে।
ঘরোয়াভাবে কেক কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বুধবার জাতীয় জাদুঘরে তার স্মৃতি-নিদর্শন নিয়ে শুরু হয়েছে পক্ষকালব্যাপী বিশেষ প্রদর্শনী।