তোষামোদের ব্যাপার-স্যাপার- আতাউর রহমান
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান নাকি একবার তাঁর এক সহযোগীকে বলেছিলেন, ‘আমাকে কেউ ফ্ল্যাটারি (তোষামোদ) করতে পারবে না।’ তদুত্তরে সহযোগী বললেন, ‘আমি আগামীকাল সকালে এসে এর জবাব দেব।’ পরদিন সকালে এসেই তিনি বললেন, ‘স্যার, আমি কাল সারা রাত বসে বসে চিন্তা করেছি—সত্যিই আপনার মতো ব্যক্তিকে কেউ ফ্ল্যাটারি করতে পারবে না।’ নেপোলিয়ান তখন হেসে ফেলে বলেছিলেন, ‘নাউ আই অ্যাম ফ্ল্যাটারড; আমাকে এখন তোষামোদ করা হলো।’ আর এ জন্যই বুঝি বলা হয়ে থাকে যে আপনি যদি কোনো একজন ব্যক্তিকে কীভাবে তোষামোদ করতে হবে ভেবে পান না, তাহলে তাঁকে বলুন, তিনি এমন একধরনের ব্যক্তি, যাঁকে তোষামোদ করা যায় না।
তো তোষামোদ জিনিসটা কী? পেঙ্গুইন ডিকশনারি অব জোকস অনুসারে তোষামোদ হচ্ছে বেঠিক কারণে সঠিক কথাটা বলার কলাকৌশল। অথবা বলা যেতে পারে, তোষামোদ হচ্ছে অন্যরা নিজেদের সম্পর্কে যা ভাবেন, সম্পূর্ণ ওই রূপ তাঁদের বলা। অন্য কথায়, তোষামোদ হচ্ছে আপনি নিজের সম্পর্কে যা ভাবেন, ঠিক তদ্রূপ অন্যের কাছ থেকে আপনার সম্পর্কে শুনতে পাওয়া। আর বিশ্বের বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি তোষামোদ সম্পর্কে অনেক সরস কথা বলে গেছেন। এই যেমন বার্নার্ড শ বলেছেন, ‘মানুষকে যা সন্তুষ্ট করে তা হচ্ছে, আপনি তাঁকে তোষামোদের যোগ্য ভাবছেন।’ আদলাই স্টিভেনসন বলেছেন, ‘আমি মনে করি, তোষামোদ কাউকে আঘাত করে না—অর্থাৎ আপনি যদি ওটাকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ না করেন।’ হাসির রাজা মার্ক টোয়েনও বলেছেন, ‘আমি আমার সম্পর্কে একটি প্রশংসাসূচক কথা উদরস্থ করে দুই মাস বেঁচে থাকতে পারব।’ অজ্ঞাতনামা আরেকজন বলেছেন, ‘তোষামোদ হচ্ছে সুগন্ধির মতো, আপনাকে ওটার ঘ্রাণ নিতে হবে, গলাধঃকরণ করা চলবে না।’
তো তোষামোদের উপকারিতা কী কী জানতে চান? তাহলে এতৎপরবর্তী চুটকি গল্পত্রয়ের প্রতি মনোনিবেশ করেন:
মহিলা (যাত্রীভর্তি টাউনবাসে দাঁড়ানো অবস্থায় ছেলেবন্ধুর প্রতি): ‘আশা করছি, বসে থাকা কোনো ভদ্র হ্যান্ডসাম ইয়াংম্যান দাঁড়িয়ে আমাকে বসতে দেবেন।’ সঙ্গে সঙ্গে তিন যুবক দাঁড়িয়ে গেলেন।
সাংবাদিক: ঘরে ঘরে ঘুরে জিনিসপত্র বিক্রির সেলসম্যান হিসেবে আপনার অভাবিত সাফল্যের কারণ কী?
সেলসম্যান: যখন কোনো গৃহকর্ত্রী দরজা খুলে দেন, তখন আমার দ্বারা উচ্চারিত প্রথম পাঁচটি শব্দ—আপা, আপনার আম্মা ঘরে আছেন?
স্ত্রী: ওগো, তুমি আবারও ভুলে গেছ যে আজ আমার জন্মদিন।
স্বামী: ডার্লিং, কী করে স্মরণ রাখি বলো? তুমি এক বছরে একটুও বদলাওনি, বরং আগের চেয়ে আরও সুন্দরী হয়েছ।
প্রসঙ্গত, স্ত্রীকে খুশি করার জন্য নির্দোষ মিথ্যা বলা সব মতেই সিদ্ধ। সে যাহোক, তোষামোদের সমার্থ বাংলা শব্দ হচ্ছে ‘চাটুকারিতা’ ও ‘চামচাগিরি’।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন পত্রিকায় প্রতিবেদন বেরিয়েছিল: তৎকালীন পাকিস্তান মুসলিম লীগের কতিপয় চামচা যখন সরকারের খয়ের খাঁ-গিরি করতে গিয়ে লাহোরের একটি জনবসতিপূর্ণ রাস্তা দিয়ে মিছিল সহকারে যাচ্ছিল, তখন গৃহিণীরা চামচ হাতে উঁচিয়ে ধরে রাস্তায় একযোগে বেরিয়ে এসে তাদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেন। পত্রিকার পাতায় ছবিসহ প্রতিবেদনটি পেড় আমরা তখন বিষয়টিকে খুব উপভোগ করেছিলাম।
আর কিশোর বয়সে যখন কলেজে অধ্যয়ন করতাম, তখন তৎকালীন ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা মর্নিং নিউজ-এর ‘থট ফর টুডে’ কলামে লেখা পড়েছিলাম, ‘ফ্ল্যাটারি করাপ্টস বোথ দ্য রিসিভার অ্যান্ড দ্য গিভার’, অর্থাৎ তোষামোদ গ্রহীতা ও দাতা উভয়কেই কলুষিত করে। ওটা ছিল মনে সহজে দাগকাটা তথা প্রভাবিত হওয়ার বয়স। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়তে এসে শেক্সপিয়ারের নাটক কিং লিয়ার পাঠ করে জেনেছিলাম: রাজা তাঁর তিন মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন, তারা কে তাঁকে কতখানি ভালোবাসে। বড় দুই মেয়ে তোষামোদ করে বলল যে তারা তাঁকে তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে; কিন্তু কনিষ্ঠ মেয়েটি বলে ফেলল, সে তাঁকে বাবা হিসেবে যতটুকু ভালোবাসার, ঠিক ততটুকুই ভালোবাসে; এর চেয়ে বেশিও নয়, কমও নয়। রাজা রাগান্বিত হয়ে তাঁকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে বসলেন ও বড় দুই মেয়েকে পুরস্কৃত করলেন। কিন্তু অতঃপর রাজার জীবনে হঠাৎ দুর্যোগ নেমে এলে পর বড় দুই মেয়ে তাঁকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেও তাঁর কনিষ্ঠ মেয়েই তাঁকে যত্ন-আত্তি করে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
এবং তোষামোদ কাকে বলে, ইহা কত প্রকার ও কী কী—এ ব্যাপারে যদি সম্যক ধারণা নিতে চান, তাহলে আপনাকে যেতে হবে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত স্থপতি লুই কানের ডিজাইন করা সুরম্য অট্টালিকাটির অভ্যন্তরে অথবা চোখ রাখতে হবে সংসদ টিভি চ্যানেলে। ওখানে সম্মানিত সাংসদেরা মওকা পেলেই, বিশেষ করে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রশ্ন উত্থাপনকালে, প্রশ্ন করার আগে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর—চাই তিনি রাষ্ট্রপতি হোন কিংবা প্রধানমন্ত্রী হোন—গুণকীর্তন করতে লেগে যান, যে কারণে স্পিকারকে বারংবার বলতে হয়, ‘অনুগ্রহপূর্বক আপনার প্রশ্ন ফর্মুলেট করুন।’
শেষ করতে চাই এ-সংক্রান্ত প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনেসের বহুল কথিত সেই উপাখ্যানটি দিয়ে—সেই ডায়োজেনেস, যিনি গুহার সামনে বসে রোদ পোহানোকালে দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের ‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি’ জিজ্ঞাসার জবাবে বলেছিলেন, ‘কিছুই করার দরকার নেই। আমি রোদ পোহাচ্ছিলাম, আপনি সূর্য আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন; একটু সরে গেলেই হয়।’
ডায়োজেনেস অত্যাচারী রাজা ডেনিসের তোষামোদ না করে খুব সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন; অন্যদিকে এরিস্টিপাস নামক তাঁর সমসাময়িক আরেক দার্শনিক রাজাকে তোষামোদ করে জৌলুশপূর্ণ জীবন যাপন করতে থাকেন। তো একদিন এরিস্টিপাস ডায়োজেনেসকে শুধু শাক দিয়ে রুটি খেতে দেখে যখন বললেন, রাজাকে তোষামোদ করে চললে আজ আপনাকে শুধু শাক দিয়ে রুটি খেতে হতো না। তখন ডায়োজেনেস নাকি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আর আপনি যদি শুধু শাক দিয়ে রুটি খাওয়া শিখতেন, তাহলে অত্যাচারী রাজাকে আপনার তোষামোদ করে চলতে হতো না।’
পাদটীকা: বন্ধুর সমালোচনা শত্রুর তোষামোদের চেয়ে শ্রেয়।
আতাউর রহমান: রম্যলেখক, ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷