খোকন রাজাকারের ফাঁসি
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফরিদপুরের নগরকান্দার পৌরসভার মেয়র ও পৌর বিএনপির সহ সভাপতি জাহিদ হোসেন খোকন রাজাকারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এর আগে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টিই প্রমাণিত হয়েছে। বাকি ১টি প্রমাণিত হয়নি।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে এ রায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। সকাল এগারটায় বিচারকরা আসন নেন এজলাসকক্ষে। শুরুতে সংক্ষিপ্ত সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
১৬ জন নারী ও শিশুসহ ৫০ জনকে হত্যা, তিনজনকে পুড়িয়ে হত্যা, ২ জনকে ধর্ষণ, ৯ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২টি মন্দিরসহ ১০টি গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, সাতজন গ্রামবাসীকে সপরিবারে দেশান্তরে বাধ্য করা ও ২৫ জনকে নির্যাতনের মতো ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধকালে নগরকান্দা থানা রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার খোকন রাজাকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(১), ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ২০ (২) এবং ৪ (১) ধারা অনুসারে এসব অভিযোগ আনা হয়। নগরকান্দার আরেক যুদ্ধাপরাধী ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে তিনি এ অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা ছিলেন বলেও অভিযোগে বলা হয়।
খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ:
নগরকান্দার মেয়র জাাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর সুনির্দিষ্ট ১১টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হলো:
অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল দখলদার পাকিস্তানী আর্মিদের সহযোগী সশস্ত্র জাহিদ হোসেন খোকন ও তার আপন বড় ভাই নগরকান্দার শান্তি কমিটির সদস্য জাফর এর নেতৃত্বে তাদের সঙ্গীয় অন্যান্য সহযোগীরা অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নগরাকান্দা থানার বনগ্রাম গ্রামে ঢোকেন। ভয়ে গ্রামের লোকজন এদিক সেদিক পালাতে থাকে। জাহিদ হোসেন খোকন ,জাফর ও অন্য রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই মোল্লা ,নাজিম উদ্দিন মোল্লাসহ ছয়জনের বসত বাড়ি লুটপাট চালিয়ে ঘরগুলো জ্বালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ওমেদ সোল্লা (মৃত), রতন মোল্লা (মৃত), মো: ইউনুস মোল্লা, মোছা: ছিয়ারুন নেছাসহ ১৯ জন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ গ্রামবাসীকে আটক করে। ছাত্তার মোল্লা ও আজিজ শেখ (বর্তমানে মৃত) এই দুইজনকে মারধর করে ছেড়ে দেয়। বাকী ১৭জনকে থানায় আটক রেখে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। আটকের দুই দিন পর আটককৃতদের স্বজনদের অনুরোধে এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের (বর্তমানে মৃত) মধ্যস্ততায় ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
অভিযোগ-২: ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ মে’র মধ্যে কোন একদিন খোকন রাজাকারের নেতৃত্বে আয়নাল রাজাকার, আতাহার রাজাকারসহ অন্য রাজাকাররা ও পাকবাহিনী নগরকান্দার জঙ্গুরদী-বাগুটিয়া গ্রামে প্রবেশ করে। সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের কানাই লালমন্ডল ও অন্য একজনের বাড়ীতে হামলা চালায়। সেখানে তাদেরকে হিন্দু থেকে মুসলিম হতে বলে অন্যথায় তাদেরকে দেশত্যাগের জন্য চাপ দেয় এবং মেরে ফেলার হুমকি দেয়। কানাই লাল মন্ডলের কাছ থেকে পাঁচহাজার ও জীবন দাসের পরিবারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করেন।
অভিযোগ-৩: ১৯৭১ সালের ১৬ মে থেকে ২৮ মে’র মধ্যে কোন একদিন আসামী সশস্ত্র রাজাকার জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন মাতব্বর ও তার আপন বড় ভাই জাফর এর নেতৃত্বে তাদের সঙ্গীয় আয়নালসহ অন্যান্য রাজাকাররা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে একজন অজ্ঞাত মৌলভীসহ জীবন দাসের বাড়িতে আসে এবং তাদের ধরে । জীবন দাসসহ তার চার ভাইকে জোরপুর্বক মুসলমান বানায় এবং তাদেরকে মুসলিম নাম দেয়া হয়। এরপর চার ভাইয়ের স্ত্রীদের হাতের শাখা ভাঙ্গিয়ে সীথির সিঁদুর মুছে মৌলভী দ্বারা কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়। এর পরে জীবন দাসসহ তার ভাইয়েরা প্রাণভয়ে ভারতে চলে যায়, পরবর্তীতে তারা আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে।
অভিযোগ-৪: ১৯৭১ সালের ২৭ মে খোকন রাজাকার ও তার আপন ভাই রাজাকার জাফরদের নেতৃত্বাধীন অন্যান্য রাজাকাররা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চাঁদহাট গ্রামের হিন্দু এলাকা বনিক পাড়ায় ঢোকেন। রাজাকারদের গ্রামে ঢুকতে দেখে গ্রামের মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। জাহিদ হোসেন খোকন স্থানীয় জগন্নাথ দত্তের বাড়িতে ঢোকেন। রাজাকাররা পলায়নরত জগন্নাথ দত্তের পিতা ভুবন মোহন দত্ত ,ভুবন মোহন দত্তের ভাইদের সহ ১৬/১৭ জনকে ধরে ফেলে। এ সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে জগন্নাথ দত্তের কাকী সুচিত্রা দত্ত (বর্তমানে মৃত) নিকট থেকে ৪২ ভরি স্বর্ণালংকার, ৩২৮ ভরি রুপার অলংকার রেডিও ও ঘড়ি ছিনিয়ে নেয়। ভিকটিম জগন্নাথ দত্তের বসতঘর ও মন্দিরে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। চাঁদহাট গ্রামের বনিক পাড়ায় খোকন রাজাকার ঠাকুর দাসের স্ত্রী রাধা রানীকে ধর্ষণ করে। একইভাবে মৃত হলধরদের অবিবাহিত কন্যা খুকুমনিকেও এ রাজাকার ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে ধর্ষিতারা তাদের পরিবার পরিজনসহ ভারতে চলে যায়।
অভিযোগ-৫: ১৯৭১ সালের ৩০ মে রাজাকার খোকন রাজাকার ও পাকহানাদার বাহিনী নিয়ে নগরকান্দার কোদালিয়া শহীদনগর গ্রামে ঢোকেন। এ সময় তারা গ্রামের অনেক বাড়িঘরে লুটপাট চালায়। ভেলুর ভিটা জঙ্গল থেকে প্রায় ৫০/৬০ জনকে এক জায়গায় আত্মগোপন থাকা অবস্থায় ধরে ফেলে রাজাকার ও পাকবাহিনী । আটকদের তিন ভাগে ভাগ করে লাইনে দাড় করানো হয়। এক পর্যায়ে খোকন রাজাকার ও তার সঙ্গীরা গুলি ও ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ১৬ জন নারী ও শিশু নিহত হয়। তাদের মধ্যে ছিল আকরামুন নেছা (৪৫), রোকসানা আক্তার (১৮), রাবেয়া বেগম (৫০), হেলেনা আক্তার (১৫), হামেদা বেগম (২৫)। রফিকুল ইসলাম কচি (দেড় বছর) শিউলী বেগমসহ (দেড় বছর) ছয় জন গুরুতর রক্তাক্ত জখম হলেও বেঁচে যায়। খোকন রাজাকার নিজে কোদালিয়া গ্রামের আফজাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে।
অভিযোগ-৬: ১৯৭১ সালের ৩০ মে সশস্ত্র রাজাকার খোকন এর নেতৃত্বে আতাহার ও আয়নাল রাজাকার সহ অন্য রাজাকারগন ঈশ্বরদী গ্রামে প্রবেশ করে। এ সময় তাদের সাথে পাকিস্তানী আর্মিও ছিল। তারা অনেক বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামের লোকজন প্রাণভয়ে পালাতে থাকলে রাজাকার খোকন এবং পাকিস্তানী আর্মিরা পলায়নরত সালাম মাতব্বর ,শ্রীমতি খাতুন , লাল মিয়া , আব্দুল মাজেদ এ চারজনকে উত্তরমাঠ নামক স্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় তারা শিশু ফুলমতিকেও গুলি করে আহত করে।
অভিযোগ-৭: ১৯৭১ সালের ৩১ মে খোকন রাজাকার এর নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকাররা পাক বাহিনী নিয়ে শহীদনগর কোদালিয়া গ্রামের পাশে দীঘলিয়া-ঘোড়ামারা বিলে আসে। সেখানে ৭১ এর ২৯ মে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষের সময় নিহত পাকিস্তানী আর্মিদের লাশের সন্ধান করে। তখন গ্রামের নিরীহ নিরস্ত্র লোকজন ভয়ে ছোটাছুটি করে এদিক সেদিক পালিয়ে যায়। এ সময় রাজাকাররা অসুস্থ পিজির উদ্দিনের বসতঘরসহ তার ঘরের পার্শ্ববর্তী তার ভাই আফাজ বেং ও সাদেকের ঘর পুড়িয়ে দেয়। ওই দিন খোকন রাজাকার স্থানীয় আছির উদ্দিন মাতব্বরকে,সফিজউদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে।
অভিযোগ-৮: ১৯৭১ সালের ৩১ মে সশস্ত্র অবস্থায় রাজাকার খোকন এর নেতৃত্বে আয়নাল রাজাকারসহ অন্যান্যরা পাকিস্তানী আর্মিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক ও হিন্দুদের নির্মূল করার জন্য পশ্চিম দিক দিয়ে গোয়ালদী গ্রামে ঢোকে। ভয়ে লোকজন পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় পলায়নরত বৃদ্ধ রাজেন্দ্রনাথ রায়কে গুলি করে হত্যা করা হয়। হান্নান মুন্সীর মায়ের কোলে থাকা তার বোন শিশু বুলু খাতুনকে হত্যা করা হয় ।
অভিযোগ-৯: ১৯৭১ সালের ৩১ মে রাজাকার খোকনের নেতৃত্বে আতাহার ,আয়নাল রাজাকারসহ অন্যান্য রাজাকাররা পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে নিয়ে উত্তর দিক দিয়ে পুড়াপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে। তারা এক পর্যায়ে রতন শেখ, বারেক মোল্লা, ছোট খাতুন, শেখ সফিসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে রতন শেখ ও ছোট খাতুনকে খোকন রাজাকার নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে। রাজাকাররা গ্রামের অনেক বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়।
অভিযোগ-১০: ১৯৭১ সালের ১ জুন খোকন রাজাকারসহ অন্য রাজাকাররা বাগাট চুড়িয়ারচর গ্রামে প্রবেশ করে। তারা সেখানে ফজলুল হকের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এছাড়াও অনেক আওয়ামীলীগ সমর্থকের বাড়িঘর লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ভয়ে পলায়নরত অবস্থায় মালেক মাতব্বর, ভাই মোশারফ মাতব্বরসহ কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া গ্রামের পশ্চিম পাড়ার দক্ষিণ মাঠের মধ্যে পলায়নরত অবস্থায় রতন মাতব্বর, আইয়ুব, মঞ্জু রানীসহ ১০/১৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-১১: ১৯৭১ সালের ১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত খোকন রাজাকার ও তার দলবল নিয়ে জংগুরদী বাগুটিয়া গ্রামে যায়। অনুমান সাড়ে ১২টার দিকে ওই গ্রামের কানাইলাল মন্ডলের বাড়িতে ঢোকে। সশস্ত্র রাজাকারদের দেখে কানাই লাল মন্ডল তাদের বাড়ির উত্তর পাশের পাটক্ষেতে পালায়। সেখান থেকে কানাইকে আটক করে তার বাড়ির দক্ষিন পাশে রাস্তার উপর নিয়ে আসে। সেখানে তার ওপর গুলি করা হয়। এতে কানাই জখম হয়।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২১ নভেম্বর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সত্যরঞ্জন দাসসহ খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৪ জন সাক্ষী।
গত বছরের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। একই বছরের ৩০ জুলাই খোকন রাজাকারকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে দু’টি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে জাতীয় দুটি দৈনিকে বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়। তারপরও তিনি হাজির না হওয়ায় ১৪ আগস্ট তার অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে খোকন রাজাকারের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়।