২০ দলীয় জোট ছাড়ছে জামায়াত!
২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামী এবার জোট ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সংমাধ্যম থেকে জানা যায়, বিএনপির রাজনীতির অন্যতম পরাশক্তি জামায়াতে ইসলামী এবার ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জোর গুঞ্জন চলছে। দীর্ঘদিন বিএপির রাজনীতির সঙ্গে জোট বেঁধে আন্দোলন- সংগ্রাম, ক্ষমতার ভাগাভাগি থেকে শুরু করে রাজপথে লড়াই করার বিশ্বস্থ রাজনৈতিক শক্তি এবার ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাচ্ছেন।
আস্থা ও বিশ্বাসে অবিচল থেকে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে দলটির ছায়াতলে এসে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করলেও বেশ কিছুদিন তাদের সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। সম্প্রতি জামায়াত নেতাদের একের পর এক ফাঁসির রায় ঘোষণার পর বিএনপির নীরবতা এবং বিগত প্রায় এক বছর জামায়াতকে আন্দোলন কর্মসূচি থেকে বাইরে রাখা সব নিয়ে দলটির সঙ্গে ভেতরে ভেতরে বিএনপির সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। আর তাই বিএনপি জোটের আন্দোলন সংগ্রামের অন্যতম এই সঙ্গী জামায়াত অনেকটা অভিমান নিয়েই জোট ছাড়ছে বলে দলের ভেতরে এবং জোটের অপরাপর শরিকদের কারও কারও মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে।
সূত্রে জানা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা পালন করা জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপির বর্তমান যে অবস্থান তাতে করে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকা দলটির জন্য আর সম্ভব হচ্ছে না। জোটবদ্ধ হওয়ায় বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেই সম্পর্কে এখন ভাটা পড়েছে। জামায়াত-বিএনপির মধ্যকার দ্বন্দ্ব তা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে ২৪ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছর কারাদন্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যুর পর বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো শোকবার্তা না দেওয়া এবং তাঁর জানাজায় কোনো নেতার অংশগ্রহণ না করা। ২৯ অক্টোবর জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও ২ নভেম্বর জামায়াতের হেভিওয়েট নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় দেওয়া ও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার পর বিএনপির নীরব ভূমিকায় থাকাকে ভালোভাবে নিতে পারছে না জামায়াত। দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় এবং তা কার্যকর করার পরও বিএনপির দায়সারা এমন নীরব আচরণ মেনে নিতে পারছে না তারা। তাই ভেতরে ভেতরে দু’দলের মাঝে ক্ষোভের দানা বেঁধেছে।
এদিকে বিএনপির রাজনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে জামায়াত বার বার প্রশ্ন তুলে বিএনপির কাছে ১০০ আসন চেয়েছে বলেও খবর বেরিয়েছে গণমাধ্যমে। বলা হয় সরকার পতন আন্দোলনে বিএনপির কোনো শক্তি-সামর্থ্য নেই। সরকারবিরোধী বিগত দিনের আন্দোলন কর্মসূচি ডাক দিয়ে মাঠে ছিল না বিএনপি। কিন্তু সেখানে কঠোরতার সঙ্গে সরকার পতন আন্দোলনে নিজেদের শক্তি, সাহস ও শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছে জামায়াত। আগামীতেও সরকারের পতন ঘটাতে হলে জামায়াত ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর তাই আগামী সংসদ নির্বাচনে যদি বিএনপি জামায়াতকে ১০০ আসনের নিশ্চয়তা দেয় তবে জামায়াত একাই সরকারের পতন ঘটাতে পারে। তবে এ বিষয়ে জামায়াতের দায়িত্বশীল কোনো নেতা স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। কিন্তু তারা সে বিষয়টি ওই সময় চেপে গেলেও এবার দলের সাবেক আমির গোলাম আযমের মৃত্যুর পর বিএনপির নীরবতাকে এক ধরনের ‘অকৃতজ্ঞ’ উল্লেখ করে গোলাম আযমের ছেলে ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লা হিল আমান আযমী তাঁর ফেসবুক ওয়ালে স্ট্যাটাসে জানিয়ে দেন জামায়াত ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারেনি, আগামীতেও আসতে পারবে না। জামায়াত নেতার ছেলের এই বক্তব্যকে যদিও বিএনপি অন্যভাবে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছে। তাদের দাবি গোলাম আযমের ছেলে জামায়াতের দায়িত্বশীল কোনো নেতা নন তাই তাঁর কথায় কিছু যায় আসে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তাঁরা আবদুল্লা হিল আমান আযমীর বক্তব্যকে আমলে নিচ্ছেন না। কারণ, তিনি জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন না।’ কিন্তু জামায়াতের সাবেক এই আমিরের মৃতের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই দলের আরও দুই নেতার ফাঁসির রায় ঘোষণার পর বিএনপির কর্মকান্ডে ব্যথিত হয়েছে জামায়াত।
এ বিষয়ে জামায়াতের এক নেতা জানান, ‘অধ্যাপক গোলাম আযম আমাদের গুরু এবং আমাদের দলের সাবেক আমির। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপির এমন নীরবতা আমরা মেনে নিতে পারি না।’
প্রসঙ্গত, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সম্প্রতি জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিএনপি বরাবরের মতোই এই রায়ে প্রতিক্রিয়া দেয়নি। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল এই পর্যন্ত ১০টি মামলার রায় দিয়েছেন। প্রতিটি রায়ের পরই প্রতিক্রিয়াহীন ছিল বিএনপি। সর্বশেষ জামায়াত নেতা নিজামীর ফাঁসির রায় দেওয়ার পর এ বিষয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সাংবাদিকদের সামনে বিষয়টি এড়িয়ে যান। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনা প্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’ আর তাই জামায়াত-বিএনপির নেতাদের এমন বিপরীতমুখী বক্তব্যকে সহজভাবে নিতে পারছে না বলে দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ব্যক্তিগতভাবে গোলাম আযমের মৃত্যুতে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
সূত্রমতে, ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠিত হওয়ার পর থেকে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের একটি অংশের মধ্যে অস্বস্তি আছে। প্রায়ই দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি, এমনকি কখনো কখনো জোটে ভাঙনের মতো খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া বিএনপির স্বাধীনতার পক্ষের নেতারা প্রথম থেকেই জামায়াতকে মেনে নিতে পারতেন না। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে অভিযোগ করেছেন এবং দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি লন্ডনে এক সভায় বলেন, ‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক নয়।’ তারেক জিয়ার ওই বক্তব্যে জামায়াত নেতারা বেশ নাখোশ হন। এছাড়া বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেও দলটির নেতাকর্মীদের রয়েছে নানা অভিযোগ।
এ বিষয়ে জামায়াতের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমরা জোটবদ্ধ হয়ে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় রাজনীতি করছি। তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার পর থেকে তারা আমাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে বেশি। আন্দোলনে-সংগ্রামে আমরাই ছিলাম সামনে, তাদের আমরা কখনোই আন্দোলনে আসতে দেখিনি। ফলে জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা হয়েছে। জামায়াত নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে অনেক নেতাকর্মী কারাবরণ করছেন। শত শত নেতাকর্মী আত্মগোপন করে আছেন। কিন্তু যাদের সঙ্গে থেকে আমরা এত আন্দোলন করলাম তাদের কাছ থেকে আমরা কি পেলাম? তাই এমন বৈরী সম্পর্ক নিয়ে পাশাপাশি চলা দুরূহ হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একমাত্র খালেদা জিয়া কিছুটা নমনীয় বলে জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক এখনও টিকে আছে। অন্যথায় আরও আগেই দলটি জোট থেকে বেরিয়ে যেত জামায়াত।’
তবে জামায়াত নেতার এই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, ‘জামায়াত বিএনপির আন্দোলনের একটি শক্তি এটা যেমন সত্য, তেমনি তারা তাদের দলের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নেতাদের বাঁচাতে আন্দোলন করেছে বেশি এটাও সত্য।’
এদিকে জামায়াত ২০ দলীয় জোট ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য শামছুজ্জমান দুদু বলেন, ‘জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল এবং আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গী। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ আমাদের মতো নয়। তাদের নিজস্ব একটি মতাদর্শ আছে। তাই তারা যদি বিএনপি জোট থেকে সরে যায় সেটি তাদের একান্ত সিদ্ধান্ত। বিএনপি কারও ওপর নির্ভরশীল নয়। বিএনপি রাজপথে আন্দোলন করে প্রতিষ্ঠিত একটি দল।’
সূত্র:ভোরের পাতা