ঈদ কবে? মাহবুব মিঠু
রোজার ঈদের আগে আগে ’ঈদের পরে আন্দোলন হবে’ এই ঘোষনায় বেশ তোলপাড় হয়েছিল। যদিও বিএনপির কোন নেতা কোন ঈদের পরে আন্দোলন হবে সেটা খোলাসা করেননি। যেহেতু রোজার মধ্যে ’ঈদের পরে’ বলতে রোজার ঈদের কথাই সঙ্গতকারণে বুঝায়। রোজার ঈদ চলে গেলেও বিএনপির আন্দোলনের কোন খবর নেই। সবাই হাসি ঠাট্টা করে বলা দিল, বেশী আগে ঘোষনা দেয়া হয়ে গেছে। আসলে ঈদ বলতে বিএনপি কুরবানীর ঈদকে বুঝিয়েছে। এরপর কুরবানীর ঈদও চলে গেল। আন্দোলনের জন্য বিএনপির নেতাদের তেমন গরজ লক্ষ্য করা গেল না। আবারো কৌতুক শুরু হোল। বড্ড বেশী আগে বলা হয়ে গেছে। আসলে ঈদ বলতে আগামী বছরের ঈদ বুঝানো হয়েছে। নেতাকর্মীরাও বিভ্রান্ত হয়ে গেল। জানতে চাইলো, বিএনপির আন্দোলনের সেই ঈদ কবে আসবে?
এভাবে আন্দোলনের নামে নানা সময় ঘোষনা দিয়েও আন্দোলনের কোন প্রস্তুতি না থাকায় দল হিসেবে বিএনপি যেমন হাসির খোরাকে পরিণত হচ্ছে, তেমনি নেতাকর্মীদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। কুরবানীর ঈদের পরে আন্দোলন শুরু করতে না পারলেও খালেদা জিয়া বেশ কয়েকটা সফল গণসংযোগ করেছেন। আপাততঃ এই হচ্ছে বিএনপির অর্জন। এর বাইরে অনেক দিন পরে ঢাকা মহানগরীর আহবায়ক কমিটি করা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার কোন অগ্রগতি নেই। নতুন কমিটির নেতাদের মধ্যে একমাত্র হাবিবুন নবী সোহেল ছাড়া কাউকে রাজপথেও দেখা যায় না। ছাত্রদলের কমিটি গঠিত হলেও সৃষ্টি হয়েছে চরম কোন্দল। পদবঞ্চিতরা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ম্যুরালও।
কমিটি গঠনের এই প্রচেষ্টা দেখে মান বাঁচাতে অনেকে বলছেন, দল গুছিয়ে অর্থাৎ কমিটি করে নাকি বিএনপি আন্দোলনে যাবে। অবশ্য লক্ষণ দেখে তা বুঝা যাচ্ছে না। ৭ই নভেম্বর সরকার বিএনপিকে কোন সভা করতে দেয়নি। বিএনপির মহানগর কমিটি কোন কার্যকর প্রতিবাদ দেখাতে পারেনি। খোকাকে সরিয়ে আব্বাসকে আনা হোল। ব্যক্তি পরিবর্তন ছাড়া কোন অগ্রগতি নেই। খোকাকে আব্বাস সহযোগিতা করে নাই। এখন খোকাও আব্বাসের পথে হাঁটছেন। মহানগর কমিটি হয়ে পড়েছে আব্বাস বনাম খোকার পারস্পরিক রেষারেষির প্লাটফরম। দলের স্বার্থ কোন বিষয় না। আব্বাস দায়িত্ব পাবার পরে খুবই দক্ষতার সাথে নিজেকে খোকার উত্তরসূরী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। আহবায়ক কমিটি করেই তারা জটে আটকে গেছেন। এই আহবায়ক কমিটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় ইচ্ছে করে করছেন না অথবা করতে পারছেনা না।
মহানগর কমিটির একমাত্র হাবিবুন নবী সোহেলকে রাজপথে দেখা যায়। সেটা নিয়েও মির্জা আব্বাসের গাত্রদাহ। ঢাকা মহানগর এবং ছাত্রদলের আহবায়ক কিম্বা অপূর্নাঙ্গ কমিটি করেও কোন লাভ হয়নি। মহানগর কমিটির মতো ছাত্রদলের কমিটিও পদ পেয়ে এক প্রকার নিস্ক্রিয়। লোক দেখানো তৎপরতা ছাড়া কার্যকর কোন ভূমিকা নেই। ছাত্রদলের নেতারা কমিটিতে জায়গা পাবার পরে মনে হচ্ছে দীর্ঘ ছুটিতে গেছে। অন্যদিকে, কমিটিতে জায়গা না পাওয়া নেতারা আন্দোলন করেছে বটে, তবে সেটা নিজ দলের বিরুদ্ধে। এরাও কিন্তু বিগত দিনগুলোতে ছাত্রদলের কমিটিতে ছিল। কমিটিতে থাকলেই সবাই শীতনিদ্রায় যায়। যতো তোড়জোড় সব কমিটিতে স্থান পাবার জন্য। যাদের মনোস্কামনা পূর্ণ হয় অর্থাৎ কমিটিতে জায়গা পায় তারা আবারো নিরব হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, যারা জায়গা পেতে ব্যর্থ তারা নিজ দলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে।
শীর্ষ নেতৃত্বকে ভাবতে হবে, এক সময়ের রাজপথ কাঁপানো ছাত্রদল কিভাবে মেছোবাঘে পরিণত হোল! ছাত্রদলের এই অধোঃউন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়েছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শেষ সময় থেকে। তখন যারা নেতৃত্বে এসেছিল সেই আমানরা কি করছে? মিলন আলমরা কোথায়? এদের বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীদের নানান অভিযোগ আছে। এরা সবাই দল ক্ষমতায় থাকতে তদবিরবাজ বলে পরিচিত ছিল। অনেকের বাসায় এলাকার তদবিরবাজরা বস্তায় লুকিয়ে টাকা আনতো। দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা টাকা দিতে না পারায় দল ক্ষমতা থাকাকালীন কোন পাত্তা পায়নি। আজকে বিএনপিতে ’বস্তা নেতাদের’ সংখ্যা কম না। ক্ষমতায় থাকালীন সংগ্রিহীত বস্তা রক্ষায় তারা মরিয়া। বস্তা ফেলে রাস্তায় নেমে আন্দোলনের সময় কৈ? উপেক্ষিত নেতাকর্মীরা কেন আবারো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলকে ক্ষমতায় এনে ’বস্তা নেতাদের’ পোয়াবারো করবে? আমান, মিলন, আলমদের পরে ছাত্রদলের কফিনে শেষ পেরেক ঢুকিয়েছে টুকু। এই জগদ্দল পাথরদের না সরিয়ে ছাত্রদলকে কোরামিন দিয়েও তাজা করা সম্ভব না। দলকে পুণর্গঠন করতে হলে এই সব ‘সুসময়ের মৌমাছিদের’ সরিয়ে সৎ, জনপ্রিয় এবং যোগ্য নেতাদের সামনে আনতে হবে।
বিএনপির মহানগর এবং ছাত্রদলের কমিটির এই যদি হয় আউটপুট, তাহলে কমিটি গঠনের জন্য আন্দোলনকে ঠেকিয়ে রাখা কেন? বিএনপির যদি সত্যি সত্যি আন্দোলন চায়, তবে কমিটির দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই।
বিএনপির আন্দোলন করতে ব্যর্থ হবার পিছনে আরো কিছু কারণ আছে। এ প্রসঙ্গে এক সময়ের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মনিরুল হক রুহুল সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু সুন্দর বিষয় তুলে এনেছেন।
প্রথমতঃ এরশাদ আমলে যারা রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে সন্ত্রাসী খেতাব পেয়েছিল, ৯০ এর পরে দল ক্ষমতায় এসে তাদেরকে সঠিক পথে পুনর্বাসিত না করে দলের এক শ্রেণীর স্বার্থবাজ নেতাদের ইন্ধনে তাদেরকে ক্রসফায়ারে হত্যা করানো হয়। নারায়নগঞ্জের ডেভিড তার মধ্যে একজন। এদেরকে সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে এভাবে মেরে ফেলাতে আর কোন তৃণমূল নেতা বা কর্মী আন্দোলন করতে গিয়ে সন্ত্রাসী আখ্যা পেয়ে নিজ দলের স্বার্থবাজ নেতাদের ইন্ধনে দল ক্ষমতায় আসলে ক্রসফায়ারে জীবন হারাতে চায় না।
দ্বিতীয়তঃ বিএনপি ৯১ সালে নির্বাচনে কিছু অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সামরিক কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়িকে নমিনেশন দেয়। দল ক্ষমতায় আসার পরে এলাকায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য দলের বাইরে নিজের আত্নীয় এমনকি জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের প্রশ্রয় দিয়ে নিবেদিতপ্রাণ দলের নেতাকর্মীদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। দলের দুর্দিনে সেই সব সুবিধাবাদীরা আজ নিস্ক্রিয়। অপরদিকে, রাজনীতি ছেড়ে দেয়াতে সত্যিকার দলের নেতাকর্মীদের আর আন্দোলনে থাকার প্রশ্ন ওঠে না।
তৃতীয়তঃ বিএনপির মধ্যে সুকৌশলে সক্রিয় কিছু জামাতপন্থী লোক ঢুকে পড়েছে। তারা বিএনপি করলেও বিএনপির চেয়ে জামাতের স্বার্থকে বড় করে দেখে। এভাবে তারা দলের মধ্যে থেকে দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
চতুর্থতঃ বিএনপিকে পকেটে রাখতে এক শ্রেণীর কেন্দ্রিয় নেতা পুরো দলকে নিজস্ব আনুগত্যপরায়ন নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কমিটিতে জায়গা করে দিয়েছে। ফলে দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা দল থেকে ক্রমশঃ দূরে সরে গেছে। দলকে বাগে আনার এই অশুভ সিন্ডিকেটকে ভাঙতে না পারলে আগামীতেও দলের অবস্থানে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।
এভাবে মূলতঃ নানা কারণে বিএনপির অসংখ্য সমর্থক থাকলেও নেতারা জনবিচ্ছিন্ন। বিএনপির একটা সাংগঠনিক সংস্কৃতি নেতাদের সাথে কর্মীদের দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। বিএনপির অনেক নেতা অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং সামরিক কর্মকর্তা হওয়াতে চাকরী ছাড়ার পরেও তারা ‘স্যার’ সংস্কৃতির বাইরে আসতে পারে নাই। এই ’স্যার’ সংস্কৃতি নেতাদের মধ্যে অহেতুক আত্নঅহমিকা সৃষ্টি করে। রাজনীতি কোন ক্যাডারভিত্তিক চাকরী বা সামরিক বাহিনীর মতো কমান্ডভিত্তিক চাকরী না। সত্যিকার রাজনীতি হবার কথা স্বেচ্ছাসেবকমূলক। বিএনপির নেতাদের এই ’স্যার’ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কর্মীদের কাছাকাছি যাবার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। বিএনপির আজকের অবস্থানের জন্য দলের জনসমর্থন কমে গেছে ভাবলে ভুল হবে। বরং আগের অনেক সময়ের চাইতে এখন দলের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন বেশী বলে অনেকেই মনে করেন। আন্দোলন না জমার পিছনে নেতাদের দলের প্রতি কমিটমেন্টের অভাবই মূলতঃ দায়ী।
বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীই মনে করেন, কমিটির দিকে চেয়ে থেকে আন্দোলনের ছক কষলে সেই আন্দোলন কখনোই আলোর মুখ দেখবে না। বরং খালেদা জিয়ার উচিত তৃণমুলের নেতাকর্মীদের সাথে সরাসরি আন্দোলনের ব্যাপারে কথা বলা। আলোচনার সময় কেন্দ্রের ব্যর্থ নেতাদের সেখানে না রাখা। উনি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে সরাসরি কথা বললে তারা উজ্জীবিত হবে। ৫ই জানুয়ারীর অবৈধ নির্বাচনের পরে এই তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই ঢাকাবাদে সারা দেশে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দৌঁড়ের উপর রেখেছিল। কেন্দ্রীয় কিছু নেতার অসহযোগিতার কারণে সে আন্দোলন পরিপূর্ণতা পায়নি। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, খালেদা জিয়া ওদের ডেকে সরাসরি কথা বললে, আন্দোলনের রূপরেখা দিলে, খোকা আব্বাসদের প্রয়োজন হবে না। ঢাকার বাইরের আন্দোলনের জোয়ারে ঢাকাও কেঁপে উঠবে।
তৃণমূলের এই বার্তাটা খালেদা জিয়াকে পৌঁছে দেবে কে? কারণ এর ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাই তো খালেদা জিয়াকে সঠিক তথ্য দিতে বাঁধা সৃষ্টি করবে।