এইচ টি ইমামের অপসারণ চাইলেন মন্ত্রীরা তাঁর ফোন ধরিনি, কথাও হয়নি : প্রধানমন্ত্রী
দক্ষ আমলা থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারই এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। মন্ত্রিসভার প্রায় সব সিনিয়র সদস্য একযোগে তাঁর অপসারণ চেয়েছেন। তাঁদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কিছু না বললেও একেবারে চুপ করেও থাকেননি। এইচ টি ইমামের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের বলেছেন, ‘তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন; আমি ধরিনি।’ গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ থেকে নিজের ছেলেকে এমপি বানিয়েছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি বানিয়েছেন। আমাদের পরীক্ষিত নেতাকে বাদ দিয়েছেন। এরপর আর কী চান?’
বৈঠক শেষে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতারা প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্য এবং তাঁর বিরক্তি প্রকাশকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিসভার একজন সিনিয়র সদস্য কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য জানান।
সূত্র জানায়, এর আগে মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষ হলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, এইচ টি ইমামের সঙ্গে তাঁর দেওয়া বিতর্কিত বক্তব্য নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না। প্রধানমন্ত্রী এতে ‘না’ সূচক জবাব দেন।
এইচ টি ইমাম গত রবিবার বিবিসিকে বলেছেন, ‘এই বিতর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ অনুযায়ী আগামীকাল (গতকাল সোমবার) এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি তাঁর বক্তব্য বিশদভাবে তুলে ধরবেন।’
এর আগে গত ১২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এইচ টি ইমাম ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে বলেন, ‘নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশ ও প্রশাসনের যে ভূমিকা; নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদেরকে দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।’ বিসিএস পরীক্ষা সম্পর্কে ছাত্রলীগ কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে, ভাইভা আমরা দেখব।’
গতকালের বৈঠক সূত্র জানায়, তোফায়েল আহমেদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী নেতিবাচক জবাব দেওয়ার পর শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যরা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। তাঁরা বিসিএস পরীক্ষা ও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এইচ টি ইমামের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। এ সময় তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার পদ থেকে এইচ টি ইমামের অপসারণ চান।
সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণ নির্বাচনের পক্ষে না থাকলে কারো পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব হতো না। এখানে ক্রেডিট নেওয়ার কিছু নেই। কে কিভাবে ক্রেডিট নিচ্ছেন সেই সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। আর নির্বাচনের মাঠে শুধু পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেটরাই ছিলেন না। সংশ্লিষ্ট সবাই ছিলেন। সেনাবাহিনী, বিজিবি, আনসার, স্কুলশিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। কাকে কোন জায়গায় রাখতে হবে, এটা আমি জানি। সেভাবেই কাজ করছি। দেশও ভালো চলছে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ বিতর্কিত কথা বলে সরকারকে বিপাকে ফেলছেন কেউ কেউ।’
সূত্র আরো জানায়, এ সময় প্রধানমন্ত্রী দুঃখ করে বলেন, আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি ভালো কাজ করার জন্য। যখন একটি ভালো কাজ নিয়ে এগোই তখন আপনারা সেটা সম্পর্কে বলবেন। তা না করে নতুন কিছু বলে বিতর্ক সৃষ্টি করা ঠিক নয়। যার যার দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে কথা না বলার এবং সব কিছু সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশ দেন।
একজন মন্ত্রী জানান, টিএসসির ওই অনুষ্ঠানে এইচ টি ইমাম আরো আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। সেসব প্রকাশ পেলে সরকারের ভাবমূর্তি আরো নষ্ট হবে।
এ সময় একজন মন্ত্রী বলেন, ভাইভায় কত নম্বর দিলে বিসিএস পাস করানো যাবে, এ সম্পর্কে এইচ টি ইমাম সঠিক তথ্য দেননি। কারণ লিখিত পরীক্ষায় পাস করার পর ভাইভার পুরো ২০০ নম্বর দিলেও অনেকের চাকরি হয় না। সেখানে এইচ টি ইমাম লিখিত পরীক্ষায় পাস করলে কিভাবে চাকরি দেবেন?
উল্লেখ্য, আগে ভাইভা পরীক্ষার মোট নম্বর ছিল ১০০। কিন্তু দলীয় প্রার্থীদের দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ভাইভার নম্বর বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। আওয়ামী লীগের ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে এ-সংক্রান্ত বিধি পরিবর্তন করা হয়।
অন্য একজন মন্ত্রী বৈঠকে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের সঙ্গে এইচ টি ইমামের বক্তব্যের কোনো যোগসাজশ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেন। কারণ কোনো মহল থেকে পরিকল্পিতভাবে এসব করা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে নির্বাচন নিয়ে সবার আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন তখন তাঁদের এসব বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে বলে তিনি বৈঠকে জানান। অন্য এক মন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি আন্দোলন করার জন্য রাজনৈতিক ইস্যু পাচ্ছে না। এসব বিষয়কে তারা ইস্যু করে জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর আমাদের কিছু নেতা সেসব ইস্যু তৈরি করে দিচ্ছেন।’
এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া) আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন। তানভীর ইমাম গত ১৫ নভেম্বর উল্লাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে আগে থেকেই। এ নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোটারও উপস্থিত ছিল না বলে নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট অভিযোগ করে আসছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ কারণে শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার বিব্রত ও অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে। এ অস্বস্তি কাটাতে নানামুখী কৌশল ও কূটনৈতিক তৎপরতাও চালাচ্ছে সরকার। এমন অবস্থার মধ্যেই খোদ দলের একজন নীতিনির্ধারক এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একজন প্রভাবশালী নেতার পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে এমন তির্যক কথায় আওয়ামী লীগ ও সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। এটা নির্বাচন নিয়ে বিরোধীপক্ষের বক্তব্য ও অভিযোগ প্রমাণে বড় অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও মনে করছেন সরকারি দলের নেতারা। এ নিয়ে গত শুক্রবার দলের সংসদীয় বোর্ডের সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগেও এইচ টি ইমাম আলোচনায় এসেছিলেন। ‘অনেক তৌফিক পেয়েছি। আর তৌফিক চাই না। তৌফিক নিয়ে বেকায়দায় আছি।’ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৮ আগস্ট গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এক সভায় এমন মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন জনপ্রশাসন উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম, জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির স্বামী ব্যারিস্টার তৌফিক নেওয়াজ- এ তিন তৌফিকের কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এমন মন্তব্য করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর বছর পার হতে না হতেই আবারও ‘তৌফিক’ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। এবার প্রধানমন্ত্রীকে বেকায়দায় ফেলেছেন তাঁরই রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম, যিনি এইচ টি ইমাম নামে পরিচিত।
সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য এইচ টি ইমাম শাস্তির মুখে পড়তে পারেন। তবে এখনই এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে দলের জন্য তা আরো বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, এমন ভাবনাও সরকারের নীতি-নির্ধারকদের রয়েছে। এইচ টি ইমামের এই বক্তব্য দেওয়ার পরের দিন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও তাঁকে সতর্ক হয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার এ বক্তব্যের কারণে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এইচ টি ইমামকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাঁর এ বক্তব্যের মাধ্যমে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। তাঁর কথায় থলের বিড়াল বের হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, মহানবী ও হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। তাঁর বক্তব্যে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হওয়ায় দল ও সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ইস্যুটি চাপা পড়তে না পড়তেই ফের নতুন বিতর্কের জন্ম দিলেন এইচ টি ইমাম। সম্প্রতি ঘুষ নিয়ে মন্তব্য করে ইসলামী দলগুলোর তোপের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গতকালের মন্ত্রিসভা বৈঠকেও প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন একজন মন্ত্রী। তবে বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ।
আনুষ্ঠানিকতা : গতকালের মন্ত্রিসভা বৈঠকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এ ভাষণে যেন সরকারের সব অর্জনের উল্লেখ থাকে তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের কাজে সচিবদের ওপর নির্ভর না করার নির্দেশনাও দেন প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সংশোধনের প্রটোকল স্বাক্ষরের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। বর্তমান আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রমিকরা মালয়েশিয়ার সব জায়গায় কাজ করার সুযোগ পান না। এই প্রটোকল সই হলে বাংলাদেশের শ্রমিকরা সারাওয়াক প্রদেশে কাজ করার সুযোগ পাবেন। বৈঠকে মালয়েশিয়ার সঙ্গে ভিসা বিষয়ে আরেকটি চুক্তি অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এ ছাড়া সভায় বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০১৪-এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। বৈঠকে সার্কভুক্ত দেশগুলোর এক দেশের যানবাহন যেন আরেক দেশে যেতে পারে, সে-সংক্রান্ত একটি চুক্তির খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে।
সদ্য প্রয়াত শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের মৃত্যুতে মন্ত্রিসভায় শোক প্রস্তাব নেওয়া হয়। এ ছাড়া জিম্বাবুয়েকে ৩-০ ব্যবধানে হারানোয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানায় মন্ত্রিসভা।