ওরা হত্যা চালিয়েই যাচ্ছে, আমরা কি শুধু রামধুন গাইব?
একাত্তরের নারীঘাতী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষে দণ্ড ঘোষিত হলেও সেই দণ্ডদান নানা অজুহাতে বিলম্বিত হচ্ছে। কিন্তু সেই অপরাধী ও মানবতার শত্রুদের সমর্থক জামায়াত ও জঙ্গিদের হাতে নিরীহ শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী হত্যা অব্যাহত রয়েছে। আমরা, আমাদের সরকার নির্দয় ও নিষ্ঠুর হতে পারছি না। এখানেই আমাদের দুর্বলতা। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা একের পর এক দেশের মুক্তবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করে চলেছে। সেই ১৯৭১ সাল থেকে চলছে এই হত্যাকাণ্ড।
ধর্মের মুখোশধারী এই হিংস্র মৌলবাদীদের সাম্প্রতিক শিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলাম। মাত্র ৫১ বছর বয়সী এই শিক্ষককে যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তাতে বুঝতে কষ্ট হয় না, এই হত্যাকাণ্ড জামায়াত-শিবির বা তাদের কোনো আশ্রিত গোষ্ঠী দ্বারা ঘটেছে। আনসার আল ইসলাম নামের একটি দল এরই মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে। জামায়াতের জঙ্গি উপদলগুলো একেক সময় একেক নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই আনসার আল ইসলামও সম্ভবত সে রকম একটি নাম। পুলিশ যদি একটু ভালোভাবে তদন্ত করে, তাহলে এই তথাকথিত আনসারদের জামায়াতসংশ্লিষ্টতা অবশ্যই ধরা পড়বে; যেমন ধরা পড়েছিল বাংলা ভাইদের জামায়াতসংশ্লিষ্টতা।
জামায়াতিদের একটা বড় অস্ত্র মিথ্যা প্রচার। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ ঢাকা দেওয়ার জন্য তারা বিশ্বময় যে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে, তা দেখে অনেকেই স্বীকার করছেন, গোয়েবলসের মিথ্যা প্রচার এদের কাছে তুচ্ছ। অধ্যাপক শফিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেও এই মিথ্যার ধূম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। আনসার আল ইসলাম এই হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব স্বীকার করার পরও গুজব ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের মূলে পারিবারিক বিরোধ রয়েছে।
কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখেই বোঝা যায়, অতীতে হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে ব্লগার রাজিব পর্যন্ত ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যার যে ধরন, অধ্যাপক শফিউলকে হত্যার ব্যাপারেও তা অনুসৃত হয়েছে। রাজশাহী শহরের যে এলাকায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, সে এলাকা জামায়াত-শিবিরের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তার ওপর জামায়াতের কাগজ দৈনিক সংগ্রাম ২০১০ সাল থেকে তাঁকে মুরতাদ প্রমাণ করার জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তিনি তাঁর সমাজবিজ্ঞানের ক্লাসে ছাত্রীরা বোরকা পরে আসুক তা পছন্দ করতেন না। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত প্রতিটি রিপোর্ট পাঠ করলেই দেখা যায়, এগুলো চরম উসকানিমূলক।
কয়েক বছর আগে নন্দিত বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক হুমায়ুন আজাদের হত্যাচেষ্টার সঙ্গে বর্তমান হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ও ধরনের মিল লক্ষণীয়। হুমায়ুন আজাদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তাঁর উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’-এ হিংস্র মৌলবাদীদের ভণ্ডামির মুখোশ তুলে ধরেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও জামায়াতের পক্ষ থেকে উসকানিমূলক প্রচারণা শুরু হয়। তাঁকে মুরতাদ আখ্যা দেওয়া হয়। স্বয়ং একাত্তরের দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তাঁর বিরুদ্ধে এমন সব উসকানিমূলক বক্তৃতা ও ফতোয়া দিতে শুরু করেন, যা ছিল তাঁকে হত্যা করার প্ররোচনাদানের শামিল। হুমায়ুন আজাদকেও অধ্যাপক শফিউল ইসলামের মতো ঘরে ফেরার পথে ঘেরাও করে দা ও কাস্তে দিয়ে নির্মমভাবে কোপানো হয়। সেই হামলায় তখনই তাঁর মৃত্যু হয়নি। কিন্তু সেই আঘাতজনিত কারণেই পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
অধ্যাপক শফিউল ইসলামেরও সম্ভবত অপরাধ, তিনি সেক্যুলারিজম ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছিলেন। আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল থেকে তিনি একাধিকবার শিক্ষক সমিতির বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও বিভাগীয় প্রধানের পদসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকে হত্যা করার পর ফেসবুকে আনসার আল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে, ‘আমাদের মুজাহিদিনরা রাজশাহীতে এক মুরতাদকে কতল করেছেন, যে তার ডিপার্টমেন্টে ও ক্লাসে বোরকা পরা নিষিদ্ধ করেছিল। আল্লার ইচ্ছায়, আল্লার শক্তিতে ও আল্লার অনুমতিতে মুজাহিদিনরা এই মুরতাদকে কতল করেছেন।’
এইভাবে ধর্মের নাম ব্যবহার করে জামায়াতি রাজনীতির স্বার্থে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক-সাহিত্যিক হত্যার শুরু ১৯৭১ সালে। সেই হত্যাকাণ্ড অদ্যাবধি অব্যাহত রাখা হয়েছে। যারা এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তারা শুধু বাংলাদেশে আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেই বাধাগ্রস্ত করছে না, ইসলামের নাম ভাঙিয়ে তার মানবিক মূল্যবোধগুলোরও অবমাননা করছে। হত্যাকাণ্ড দ্বারা বুদ্ধিজীবীমহলে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এরা দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে চায়। এদের দমনে সরকারের সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিংস্র মৌলবাদীদের হাতে অধ্যাপক শফিউল ইসলামই যে প্রথম খুন হলেন, তা নয়; এর আগে ২০০৪ সালে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসকে এবং ২০০৬ সালে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম তাহেরকে। অধ্যাপক ইউনুস হত্যার আজ পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। সুতরাং অধ্যাপক শফিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবিধানে পুলিশ সাফল্য দেখাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?
এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ হচ্ছে সর্বত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজও নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। পুলিশ কিছুসংখ্যক লোককে গ্রেপ্তারও করেছে। এখানেই যেন পুলিশের সব দায়দায়িত্ব শেষ না হয়। শুধু রাজশাহীর মাটি থেকে নয়, দেশের মাটি থেকে জঙ্গি তথা হিংস্র মৌলবাদীদের উৎখাতের জন্য সরকারের সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। বর্তমানে জামায়াতিরা রাজপথের সন্ত্রাস থেকে কিছুটা বিরত রয়েছে। কিন্তু মুক্তবুদ্ধির বুদ্ধিজীবী হত্যা দ্বারা দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেওয়া ও তালেবান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গোপন পরিকল্পনা তারা পরিত্যাগ করেনি। রাজশাহীর সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডই তার প্রমাণ।
দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসী দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য দেশের প্রগতিশীল একটি মহল দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কেবল দল নিষিদ্ধ করে এই সন্ত্রাস দূর করা যাবে না; এই সন্ত্রাসের উৎসমূলে সরকারকে হাত দিতে হবে। পাকিস্তানে জঙ্গি দমনের জন্য দুই হাজারের মতো মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই মাদ্রাসাগুলো ছিল জঙ্গি রিক্রুট, তাদের মস্তিষ্ক ধোলাই ও প্রশিক্ষণদানের কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গে কয়েক হাজার মাদ্রাসা জঙ্গিদের ঘাঁটি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত আছে কয়েক শ মসজিদও।
বাংলাদেশে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এই মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলো স্ক্রিনিং করার কাজ শুরু করা দরকার। সেই সঙ্গে দেশের ভালো মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোকেও জামায়াতের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও জঙ্গিমুক্ত রাখার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। যেসব এলাকায় জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে, যেমন- রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা- এসব অঞ্চলে চিরুনি অভিযান চালিয়ে হিংস্র মৌলবাদে দীক্ষা নেওয়া যুবকদের গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন। কারাদণ্ড দেওয়ার বদলে তাদের জন্য কারেকশন সেন্টার বা সংশোধনাগার স্থাপন করে সেখানে তাদের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এসব ক্যাডারের যারা এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডে হাত পাকিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে যারা ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে উসকানি দেয়, তাদেরও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হওয়া উচিত। হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফতোয়া যেমন বিপজ্জনক ছিল, তেমনি বিপজ্জনক ছিল অধ্যাপক শফিউল ইসলামের বিরুদ্ধে জামায়াতি পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামের প্রচারণা। সময় থাকতে এসব প্রচারণার মোকাবিলা করা উচিত ছিল এবং এই ধরনের প্রচার যারা চালায়, তাদের কঠোর শাস্তিদানের জন্য আইন প্রণয়ন করা উচিত ছিল। সংগ্রামের মতো যেসব পত্রিকা এ ধরনের প্রচারণা চালায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’র নামে আমাদের এক শ্রেণির সাংবাদিক চেঁচামেচি জুড়তে পারেন, তা বৃহত্তর জননিরাপত্তার স্বার্থে সরকারকে উপেক্ষা করতে হবে।
গণতন্ত্রের পীঠস্থানরূপে পরিচিত ব্রিটেনে কেবল টেলিফোন হ্যাকিং দ্বারা নাগরিকদের প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন করার অপরাধে ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের ২০০ বছরের প্রাচীন ও বহুল প্রচারিত কাগজটির সম্পাদককে সরকার গ্রেপ্তার করে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপের মুখে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে কোনো চেঁচামেচি হয়নি। বরং সরকার সংবাদপত্রের বল্গাহীন প্রচারণা থেকে নাগরিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দেশের প্রেস আইন সংশোধন করেছে।
বর্তমান সরকারকে বুঝতে হবে, সেই ১৯৭১ সাল থেকে জামায়াত ও তাদের হিংস্র উপদলগুলো দেশে যে বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করেছিল, তা এখনো তারা বন্ধ করেনি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ডদানটি ঝুলিয়ে রাখা হলে এই ঘোষিত দণ্ড অকার্যকর করার জন্য অপরাধীদের সমর্থক ও অনুসারীরা এই নৃশংসতা চালিয়ে যাবেই। এই নৃশংসতা নিরুৎসাহ করার জন্যও যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ডদান আর বিলম্বিত করা উচিত নয়। ওরা হত্যা চালিয়েই যাবে, আর আমরা রামধুন গাইব, তা হয় না। অধ্যাপক শফিউল ইসলামের হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে পুলিশও এবার একটু সাফল্য দেখাক।
লন্ডন, সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৪